জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কাজ হারাচ্ছেন কৃষিশ্রমিকেরা
জলবায়ু পরিবর্তন ও চিরায়ত কৃষিচিত্র পাল্টে যাওয়ায় কাজ হারাচ্ছেন নওগাঁর কৃষিশ্রমিকেরা। কাজ না থাকায় জীবিকার তাগিদে এসব মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নারী ও শিশুদের তুলনায় কর্মঠ পুরুষের মধ্যে অভিবাসনের মাত্রাটা বেশি। অভিবাসনের কারণে চাপ পড়ছে বড় বড় শহরে।
আজ বুধবার নওগাঁ সার্কিট হাউস মিলনায়তনে বেসরকারি সংস্থা বরেন্দ্র উন্নয়ন সংস্থা (বিডিও) আয়োজিত ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন: প্রেক্ষিত নওগাঁ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বেসরকারি সংস্থা একশনএইডের সহযোগিতায় বিডিও নওগাঁর স্থানীয় বিভিন্ন অংশীজনকে নিয়ে এই সভার আয়োজন করে।
বিডিওর পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাদেকুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন নওগাঁর জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন নওগাঁ-৬ (রাণীনগর ও আত্রাই) আসনের সাবেক সাংসদ ওহিদুর রহমান, জেলা সমাজসেবাবিষয়ক কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ ও নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম খান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিডিওর নির্বাহী পরিচালক আখতার হোসেন, প্রকল্প সমন্বয়কারী নাজমুল ইসলাম, নওগাঁ জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কায়েস উদ্দীন, নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক আবদুল জব্বার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাপাহার উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার ওমর আলী প্রমুখ।
আলোচনার শুরুতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নওগাঁয় অভিবাসন চিত্র নিয়ে একশনএইডের একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা দল নওগাঁর সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী ইউনিয়নের ৭২টি পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত নওগাঁর সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খরার মতো দুর্যোগের মাত্রা বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব এলাকার খাল, বিল ও নদীতে পানি না থাকায় বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) স্থাপিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে কৃষি আবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে। ফলে অতি খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত নওগাঁর সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেচসংকটে পানি বেশি প্রয়োজন, এমন ফসল বাদ দিয়ে কৃষিজমিতে আমের বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। চিরায়ত কৃষিচিত্র পাল্টে যাওয়ায় মানুষের জীবন-জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের কারণে কিছু মানুষ লাভবান হলেও বিপাকে পড়ছেন দিনমজুরেরা। ফসলের আবাদ কমে যাওয়ায় কাজ হারাচ্ছেন কৃষি শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে কৃষি শ্রমনির্ভর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। কৃষিকাজ না থাকায় জীবিকার তাগিদে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন এসব মানুষ। নারী ও শিশুদের তুলনায় কর্মঠ পুরুষের মধ্যে অভিবাসনের মাত্রাটা বেশি।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, নওগাঁর খরাপ্রবণ এলাকার অধিকাংশ কৃষিজমিই এক ফসলি। এখানকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে। স্থানভেদে যা ৮০ থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত গভীর। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এসব এলাকায় চাষাবাদের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বেকার সমস্যা বাড়ছে। কৃষিকাজ না থাকায় জীবিকার তাগিদে কাজ হারানো এসব মানুষ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শিল্পনগরীগুলোতে গিয়ে রিকশাচালক হিসেবে কিংবা পোশাক কারখানা, শিল্পকারখানা ও গৃহকর্মী হিসেবে শ্রম বিক্রি করছেন। এতে চাপ পড়ছে এসব শহরে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসন সমস্যা ঠেকাতে আলোচনা সভায় বক্তারা খরাপ্রবণ এলাকায় খরাসহিষ্ণু ফসল চাষ, ওই সব এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ, নারী-পুরুষ ভেদে মজুরির বৈষম্য দূর করা, উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন।