ছেলেকে যখন কোপানো হয়, বাবা তখন নৌকার ভোটার টানছিলেন

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বাইরে তাসিবের বাবার আহাজারিছবি: প্রথম আলো

অ্যাম্বুলেন্সে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জসিম উদ্দিন। সারা রাত যে নির্ঘুম কেটেছে, তা হ্যাংলা–পাতলা গড়নের লোকটির চেহারাতেই স্পষ্ট। অপেক্ষা করছিলেন প্রাণের তাসিবের জন্য। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে তখন তাসিবের শরীরের ব্যবচ্ছেদ চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে ছেলের প্রাণহীন দেহটি বয়ে নিয়ে যাবেন বাড়িতে। তাই অপেক্ষা। দুই চোখ শুকিয়ে গেছে এই রিকশাচালকের। আর কান্না আসছে না।

ঘড়িতে তখন মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টা। ঠিক এই সময়ে আগের দিন সোমবার বাড়ির পাশে ভোটকেন্দ্রের কাছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মো. তাসিবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জসিম উদ্দিন ভুলতে পারেন না সময় আর ছেলেটাকে।

মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে জসিম বলতে থাকেন, ‘আমি সকাল থেকে নৌকার পক্ষে ভোটারদের রিকশায় কেন্দ্রে আনা-নেওয়া করছিলাম। বয়স্ক লোকদের পৌঁছে দিচ্ছিলাম কেন্দ্রে। আবার নিয়ে যাচ্ছিলাম বাড়িতে। হঠাৎ দৌড়াদৌড়ি। কে যেন পড়ে আছে শুনলাম।’

এবার একটু থামলেন জসিম। নিজের বুক চেপে আবার বলতে লাগলেন, ‘কে পড়ে আছে, দেখতে যাচ্ছে সবাই। আমিও গেলাম। কে জানত ওটা আমার ধন, আমার তাসিব।’ এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন জসিম উদ্দিন।

সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের মরফলা গ্রামের বাসিন্দা জসিম। বোর্ড অফিস ভোটকেন্দ্রের পাশেই জসিমের ছোট্ট একটা টিনের ঘর। দুই মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে তাসিব সবার বড়। ওই ভোটকেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংসতার সময় এমন ঘটনা ঘটেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। হঠাৎ আতঙ্ক তৈরি করতে কেন্দ্রের বাইরে শিশুটিকে নৌকার প্রার্থীর অনুসারীরা হত্যা করে বলে অভিযোগ। তবে হত্যাকারীদের কেউ চেনেন না।

মর্গে জসিমের সঙ্গে আসেন তাঁর আত্মীয় মো. দেলোয়ার ও আবদুল আজিজ। তাঁরা বলেন, এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদেরকে তাঁরা চেনেন না। ভোটকেন্দ্রে আতঙ্ক তৈরির জন্য তাসিবকে তারা হত্যা করেছে। ভোটের বলি হতে হলো তাকে।

আজিজ বলেন, ‘কেন্দ্রে সবাই নৌকায় ভোট দিচ্ছিলেন ওপেন। আমরা তো নৌকায় ভোট দিয়েছি। জসিমও নৌকার ভোটার টানছিল। হঠাৎ বহিরাগতরা এটা করেছে।’

গলায় আঘাত করা হয়েছিল তাসিবকে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এরপর লাশ সোমবার দুপুরে বাড়িতে রাখা হয়। পরে থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে মঙ্গলবার মর্গে পাঠানো হয়।

কাঁদতে কাঁদতে জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি। অনেক কষ্ট করে রিকশা টেনে ছেলেকে পড়াচ্ছিলাম। তাসিবের ছোট বোনটি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আরেকটি এখনো ছোট। আমার ধন এভাবে চলে গেল, মেনে নিতে পারছি না।’

গতকাল হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বলেছিলেন, হত্যাকারীদের ফাঁসি চান তিনি। কিন্তু আজ বলছেন, তার কোনো অভিযোগ নেই, কারও বিরুদ্ধে।

বেলা একটার দিকে মর্গ থেকে ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ান হতভাগ্য বাবা জসিম উদ্দিন।