দুই মাস ধরে শত্রুমর্দন গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনা ঘটে। উজির মিয়ার ঘরেও চুরি হয়। অতিষ্ঠ এলাকাবাসী চুরি বন্ধে গ্রামে একাধিক বৈঠক করেন। পরে গ্রামবাসী থানায় লিখিত অভিযোগও দেন। উজির মিয়া বৈঠকে এবং বৈঠকের বাইরেও এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি এলাকার চিহ্নিত কয়েকজন চোরের নাম ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শত্রুমর্দন গ্রামের বাসিন্দা উজির মিয়া (৪০) পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেছে পরিবার। আর সেই নির্যাতনে উজিরের মৃত্যু হয়।
ঘটনার পর ওই গ্রামে একাধিকবার গিয়ে পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে। এর বাইরে গ্রামে দুই গোষ্ঠীর পুরোনো বিরোধকে কাজে লাগানো হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
উজির মিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। একসময় সৌদি আরবে ছিলেন।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত শান্তিগঞ্জ থানার এসআই দেবাশীষ সূত্রধরকে গতকাল বুধবার জেলার দিরাই থানায় বদলি করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের দুটি পৃথক কমিটি কাজ করছে।
গ্রামের বাসিন্দা আজাদ মিয়া বলেন, উজির মিয়া একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। তিনিই চুরির বিরুদ্ধে বেশি কথা বলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো পরে তাঁকেই ফাঁসানো হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি জীবন দিয়েছেন।
উজির মিয়ার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বাড়ি থেকে উজির মিয়াকে যখন শান্তিগঞ্জ থানার একদল পুলিশ মারতে মারতে ধরে নিয়ে যায়, তখন বারবার পুলিশকে জিজ্ঞেস করেও কোনো কারণ জানতে পারেননি তাঁরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী রসুলপুর গ্রামের ‘চিহ্নিত চোর’ শামীম মিয়াও ছিলেন। পরে উজির মিয়াকে থানায় নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। পরদিন তাঁকেসহ চারজনকে একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ওই দিনই আদালত থেকে শামীম মিয়া বাদে উজির মিয়াসহ অন্য তিনজন জামিনে ছাড়া পান।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যে মামলায় উজিরকে আদালতে পাঠানো হয়, সেটি গত ১৪ জানুয়ারি দায়ের করেছিলেন এলাকার আমরিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুর উদ্দিন। কিন্তু এজাহারে উজির মিয়ার নাম নেই। পুলিশের দাবি, এ মামলায় গ্রেপ্তার অন্যদের স্বীকারোক্তিতে উজির মিয়ার নাম আসায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
বাড়িতে নিয়ে আসার পর উজির মিয়ার পুরো শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখতে পান পরিবারের লোকজন। তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না। এরপর উজির মিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে আবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। গত সোমবার সকালে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে স্থানীয় কৈতক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উজির মিয়ার ছোট ভাই ডালিম মিয়ার ভাষ্য, তাঁরা বুঝতে পারছেন না, পুলিশ কেন তাঁর ভাইকে এভাবে নির্যাতন করেছে, কেন তাঁর প্রতি এত ক্ষোভ ছিল। ডালিম মিয়া বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে সবকিছু পরিকল্পিত। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি চাই।’
পুরোনো বিরোধ আলোচনায়
২০১৭ সালের ১৬ মে ফেসবুকে এলাকার একটি সেতুর নিম্নমানের কাজের ছবি পোস্ট করা নিয়ে হামলার শিকার হন একই গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রনজিত সূত্রধর। হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। এ হামলায় অন্যদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন উজির মিয়া। পরে এ ঘটনায় জেলও খাটেন তিনি। শেষমেশ এটি মীমাংসা হয়ে যায়। এখন উজির মিয়ার মৃত্যুর বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসআই দেবাশীষ সূত্রধর ইউপি সদস্য রনজিত সূত্রধরের আত্মীয়। দেবাশীষ শান্তিগঞ্জ থানায় আসার পর রনজিতের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ঘটনার পেছনে এ পুরোনো বিরোধকে কাজে লাগানো হয়ে থাকতে পারে।
তবে রনজিত সূত্রধর প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘দেবাশীষ আমার বড় ভাইয়ের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। উজির মিয়ার পরিবারের সঙ্গে যে সমস্যা ছিল, সেটি মিটমাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। দুই পরিবারের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। আমি নিজেও উজির মিয়ার সঙ্গে চুরির প্রতিবাদ করেছি। লিখিত অভিযোগে স্বাক্ষর করেছি।’
উজির মিয়ার চাচাতো ভাই গোলাম মস্তফা বলেন, ‘আমরা ভাই হারিয়েছি। এটা জোর দিয়ে বলতে পারি সে নির্দোষ। সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করত। এটাই তার কাল হয়েছে। পেছনে যদি আর কোনো কারণ থাকে, সেটা বের করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা নিশ্চয়ই সেটা যথাযথভাবে পালন করবেন।’
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, সার্বিকভাবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত চলছে, যা কিছু হচ্ছে, আইনের ভেতর দিয়ে স্বচ্ছতার ভিত্তিতেই হচ্ছে।