চাকরি গেল পরিচয়পত্রের কারণে, এখন হাত পেতে বেড়ান মানুষের দ্বারে

ময়মনসিংহ জেলার মানচিত্র

১৯৮৮ সালে গ্রাম পুলিশের সদস্য পদে চাকরিতে যখন যোগ দেন, তখন গিয়াস উদ্দিনের কাছে বয়সের দালিলিক প্রমাণপত্র চাওয়া হয়নি। তখন শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক দেখেই তাঁকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সার্ভিস বুকে জন্মসাল উল্লেখ রয়েছে ১৯৬৮। পরে তিনি জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দেন, সেখানেও ১৯৬৮ সাল লেখা। অথচ তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল ১৯৫৮ উল্লেখ রয়েছে। আর এ যুক্তিতেই গত ডিসেম্বরে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বলা হয়, গিয়াস উদ্দিনের চাকরির বয়স নেই। তিনি উল্টো তথ্য গোপন করে সাড়ে তিন বছর অতিরিক্ত সময় চাকরি করে সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

ঘটনাটি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার। মহল্লাদার (গ্রাম পুলিশ সদস্য) গিয়াস উদ্দিন উপজেলার রাজগাতী ইউনিয়নের আউটারগাতী গ্রামের বাসিন্দা।

জানা যায়, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদ উদ্দিন একটি চিঠি দিয়ে গিয়াস উদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতির কথা জানান। ইউএনও তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে গিয়াস উদ্দিনের জন্মতারিখ ১৩ জুন ১৯৫৮ লেখা রয়েছে। তাই সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী ২০১৭ সালের ১২ জুন তাঁর চাকরিকাল শেষ হয়েছে। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন এ তথ্য গোপন করে সাড়ে তিন বছর অতিরিক্ত সময় চাকরি করে সরকারি অর্থ গ্রহণ করেছেন, যা আত্মসাতের শামিল। চিঠিতে আরও বলা হয়, গিয়াস উদ্দিন নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র ঘষামাজা বা প্রযুক্তির সহায়তায় বয়স কমিয়েছেন, যা প্রতারণা ও ফৌজদারি অপরাধের শামিল।

জাতীয় পরিচয়পত্রে গিয়াসের জন্মতারিখ ১৯৫৮ সালের ১৩ জুন লেখা রয়েছে। অথচ অনলাইনে নিবন্ধিত জন্মনিবন্ধন সনদে তাঁর জন্মতারিখ ১৯৬৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর উল্লেখ করা রয়েছে। এ বিষয়ে গিয়াস উদ্দিন বলেন, উপজেলার রাজগাতী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ২০১৯ সালের ৫ জুলাই তাঁকে জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর ভুল জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে।

গিয়াস অভিযোগ করে বলেন, জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তাঁর চাকরির মেয়াদ ২০২৭ সালে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় বছর আগেই তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁকে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এখন তিনি কী করছেন, জানতে চাইলে গিয়াস বলেন, চাকরি চলে যাওয়ার পর চার মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে কিছুদিন অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়েছেন। পরে স্ত্রী-সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে প্রথমে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব সড়কে চলাচলকারী বাসগুলোতে উঠে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ভিক্ষা করতেন। ইদানীং লকডাউনের কারণে বাস চলাচল বন্ধ। তাই ওই সড়কে চলাচলকারী ইজিবাইক ও অন্য গাড়ির যাত্রীদের কাছে হাত পাতছেন।

চাকরি হারানোর পর জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করেছেন গিয়াস উদ্দিন। তাঁর ভাষ্য, সেটি নির্বাচন কমিশনের ভুল ছিল। তা ছাড়া তাঁর কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নেই। তাই প্রমাণ হিসেবে তিনি জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দিয়ে বয়সের ভুল সংশোধনের জন্য নির্বাচন কমিশন বরাবর অনলাইনে আবেদন করেছেন।

গত ২৪ জুন নান্দাইল নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে উপজেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফখরুজ্জামান বলেন, গিয়াস উদ্দিন তাঁর বয়স সংশোধনের জন্য গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের কাছে অনলাইন পদ্ধতিতে আবেদন করেছেন। তাঁর আবেদনটি ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তাঁর কার্যালয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।

জন্মসাল ভুল হলে এত দিন কেন সংশোধন করেননি, জানতে চাইলে গিয়াস বলেন, এটি তো (জন্মসনদ) এত দিন কেউ চায়নি। তাই তিনি এর গুরুত্ব বোঝেননি। তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে তিনি যখন গ্রাম পুলিশের সদস্য পদে চাকরিতে যোগদান করেন, তখন তাঁর কাছে বয়সের দালিলিক প্রমাণপত্র চাওয়া হয়নি।

নান্দাইল থেকে সদ্য বদলি হওয়া ইউএনও মো. এরশাদ উদ্দিনের সঙ্গে সম্প্রতি এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, মহল্লাদার গিয়াস উদ্দিন জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে তাঁর জন্মতারিখ পরিবর্তন করেছেন। যাচাইকালে এটি প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

১৯৮৮ সালে চাকরিতে যোগদানের সময় তো জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেওয়ার প্রচলন ছিল না। এ ছাড়া চাকরিতে যোগদানের সময় গিয়াস উদ্দিন যেসব তথ্য জমা দিয়েছিলেন, সেগুলো যাচাই করা হলো না কেন, জানতে চাইলে ইউএনও জাতীয় পরিচয়পত্রের জালিয়াতির প্রসঙ্গের বাইরে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।