গ্রেপ্তার আরও ৪, মুহিবুল্লাহ হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন ১৯ জন
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে আরও চারজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। আজ শনিবার ভোররাত চারটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন লম্বাশিয়া শিবিরের বাসিন্দা আজিজুল হক, ক্যাম্প-১/ইস্ট ব্লক ডি-৮-এর বাসিন্দা মো. রশিদ প্রকাশ মুরশিদ আমিন, একই ক্যাম্পের ব্লক-বি-এর মো. আনাছ ও নুর মোহাম্মদ। এর মধ্যে আজিজুল হককে আটকের সময় একটি ওয়ান শুটারগান ও একটি তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় রোহিঙ্গারা গ্রেপ্তার এই চার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য দাবি করেছেন। সংগঠনটি আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত। তবে পুলিশ বলছে, ক্যাম্পে আরসা কিংবা আল-ইয়াকিন নামে কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আরসা ও আল-ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম চালাচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আজিজুল হক ও অপর তিনজন মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। হামলায় আজিজুল হকসহ ১৯ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী অংশ নেন। এর মধ্যে পাঁচজনের হাতে অস্ত্র ছিল। সর্বশেষ গ্রেপ্তার চার রোহিঙ্গাকে আজ শনিবার দুপুরে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও পাঁচজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছিল এপিবিএন। এ নিয়ে মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার মোট ৯ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশ জানায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ (৪৮)। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। হামলার পেছনে মিয়ানমারের সশস্ত্র গ্রুপ আরসার কয়েকজন অস্ত্রধারীর নাম প্রচার করা হয়। পরদিন মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন।
মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার প্রথম পাঁচজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে দুই দফায় তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে উখিয়া থানার পুলিশ। তাঁদের একজন মোহাম্মদ ইলিয়াছ কক্সবাজার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
এদিকে সন্ত্রাসীদের হুমকি–ধমকিতে ইতিমধ্যে মুহিবুল্লাহর পরিবারসহ নিরাপত্তাঝুঁকি থাকা পাঁচটি পরিবারের অন্তত ৩০ জন রোহিঙ্গাকে উখিয়ার লম্বাশিয়া শিবির থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিবারগুলো ১০ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার যেকোনো একটি দেশে আশ্রয় চেয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ে আবেদন করেছে।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আজিজুল হক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেন, মুহিবুল্লাহকে হত্যার দুই দিন আগে ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে লম্বাশিয়া মরকজ পাহাড়ে একটি সভা হয়। ওই সভায় আজিজুল হকসহ পাঁচজন অংশ নেন।
মুহিবুল্লাহ হত্যায় অংশ নেন ১৯ জন
আজ শনিবার বেলা সোয়া একটার দিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে এপিবিএন কার্যালয়ে মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার নতুন চার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এপিবিএন। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত উল্লেখ করে সেখানে এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, গ্রেপ্তার আজিজুল হক ছিলেন মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ‘কিলিং স্কোয়াডের’ অন্যতম সদস্য। আজ ভোররাতে আজিজুল হককে লম্বাশিয়া শিবিরের লোহার ব্রিজ এলাকা থেকে একটি ওয়ান শুটারগানসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পরে ক্যাম্পের বিভিন্ন আস্তানা থেকে অপর তিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মো. আনাছ, নুর মোহাম্মদ ও মো. রশিদ প্রকাশ মুরশিদ আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আজিজুল হক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেন, মুহিবুল্লাহকে হত্যার দুই দিন আগে ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে লম্বাশিয়া মরকজ পাহাড়ে একটি সভা হয়। ওই সভায় আজিজুল হকসহ পাঁচজন অংশ নেন। সভায় ওই দুর্বৃত্তদের তথাকথিত শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মুহিবুল্লাহকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন মর্মে আলোচনা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করায় দিনে দিনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে উঠেছেন। তাঁকে থামাতে হবে। এ জন্য তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে এশার নামাজের পর হত্যার সময়ক্ষণ ঠিক করা হয়।
পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, এশার নামাজের পর প্রত্যাবাসন বিষয়ে কথা আছে বলে মুহিবুল্লাহকে ডেকে নিয়ে যান গ্রেপ্তার মুরশিদ আমিন। এরপর সেখানে পৌঁছান মো. আনাছ ও নুর মোহাম্মদ। তাঁরা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করার জন্য দলের অন্য সদস্যদের ঘটনাস্থলে আসার সংকেত দেন। এ সময় মুখোশধারী সাতজন তাঁদের পিছু নেন। দুর্বৃত্তদের দলটির মধ্য থেকে তিনজন অস্ত্রধারী মুহিবুল্লাহর অফিস কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করেন। অফিসের দরজায় অবস্থায় নেন অস্ত্রধারী মো. আনাছ, নুর মোহাম্মদ, আজিজুল হক ও অপর একজন। মুহিবুল্লাহ তখন ১০-১৫ জন রোহিঙ্গা নিয়ে অফিসের ভেতরে ছিলেন। অস্ত্রধারী তিনজনের একজন মুহিবুল্লাহর কাছে গিয়ে বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ উঠ।’ মুহিবুল্লাহ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে প্রথম একজন একটি গুলি ছোড়েন। গুলিটি মুহিবুল্লাহর বুকে লাগে। এরপর আরেকজন দুটি গুলি ছোড়েন। এরপর আরও একটি গুলি ছোড়া হয়। মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ মুহিবুল্লাহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
গ্রেপ্তার আজিজুল হক পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আরও বলেন, মুহিবুল্লাহকে গুলি করার পর তিনি, মো. আনাছ ও নুর মোহাম্মদ এই তিনজন মুহিবুল্লাহর অফিসসংলগ্ন পেছনের রাস্তা দিয়ে পেঁপেবাগান হয়ে পালিয়ে যান। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য তাঁরা একেক সময় একেক জায়গায় আত্মগোপন করেন। মুঠোফোনও বন্ধ রাখেন। মুহিবুল্লাহ কিলিং স্কোয়াডে ১৯ জন ছিলেন, এর মধ্যে পাঁচজন ছিলেন অস্ত্রধারী।
পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, সন্ত্রাসীদের ধরতে ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ১৪ এপিবিএন পিস্তল, দেশে তৈরি ৫২টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৮৭ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে।
গতকাল শুক্রবার থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) প্রধান ও ডিআইজি আজাদ মিয়া। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিআইজি আজাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাঁদের শনাক্ত করা হয়েছে। শনিবার চারজনসহ মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার এ পর্যন্ত ৯ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা আরসা ও আল-ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে ক্যাম্পে অপকর্ম চালাতেন।