‘গরিবের মাছ’ পাঙাশ চাষ করে কোটিপতি
ইলিশ, বোয়াল, রুই, কাতল, মৃগেল—এসব মাছের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ মাছগুলো কম কেনেন। সে তুলনায় সুস্বাদু ও কম দামে পাওয়া যায় বলে পাঙাশ মাছের চাহিদা বেশি। মাছটি ‘গরিবের মাছ’ হিসেবে পরিচিত। এর মাছ চাষ করে কোটিপতি হয়েছেন বেলায়েত হোসেন। ২০২১ সালে তিনি টাঙ্গাইল জেলার সেরা মৎস্যচাষি ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার প্রতিযোগিতার জন্য তাঁর নাম মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের কালমেঘা গ্রামের সলিম উদ্দিনের ছেলে বেলায়েত হোসেন। তাঁর নিজ গ্রাম ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের ৪০ একর জমিতে ১২টি পুকুরে তিনি পাঙাশসহ দেশি জাতের মাছ চাষ করেন। ২০২১ সালে তিনি প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। খরচ বাদে সে বছর প্রায় কোটি টাকা আয় করেন তিনি।
বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৩ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি জীবিকার সন্ধানে সিঙ্গাপুরে যান। ১৩ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে কয়েক লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। গ্রামের কয়েকটি পুকুর ইজারা নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। স্থানীয় মৎস্য কার্যালয় থেকে মাছ চাষের পরামর্শ নেন তিনি। পরে পাঙাশের পোনা সংগ্রহ করে প্রথমে ছোট পাঁচটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন বেলায়েত। প্রথম বছরেই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি লাভ হয়। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ান পুকুরের সংখ্যা। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বেলায়েতের মৎস্য খামারে গিয়ে দেখা যায়, কালমেঘা ইলিমজান উচ্চবিদ্যালয়ের পেছনে দেড় একরের একটি পুকুরে কয়েক কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মাছের খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছেন। কর্মচারীদের কয়েকজন করছেন পুকুরের পরিচর্যা। আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বয়সী মোট ১৪ কর্মচারী কাজ করছেন তাঁর মৎস্য খামারে।
বহুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বেলায়েত মাছ চাষ করে অল্প সময়ে সফলতা পেয়ে জীবনের মোড় ঘুরিয়েছেন। এমন দৃষ্টান্ত দেখে স্থানীয় অনেক বেকার যুবক মাছ চাষে ঝুঁকছেন। এরই মধ্যে অনেক যুবক সফলতাও পেয়েছেন।
বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘বিদেশে অনেক কষ্ট করে পয়সা কামাতে হয়। দেশে বসে পরিশ্রম করলে অনেক সফল হওয়া যায়। পাঙাশ হচ্ছে গরিবের মাছ। বাজারে দাম কম। চাষ করাও সহজ। তবে মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তেমন লাভ হচ্ছে না। তবে মাছ চাষের শুরুটা ছিল কঠিন। মনের ভেতর প্রচণ্ড সাহস আর আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে দ্রুত সফলতা পেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের সরকারিভাবে সহায়তা করে মাছ চাষে আগ্রহী করে তোলা উচিত। এতে দেশের বেকার সমস্যা কমার পাশাপাশি উন্নত হবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার।’
পাঙাশ চাষ করে আরও অনেক যুবক সফলতা পেয়েছেন জানিয়ে বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘বেকার অনেক ছেলে আমার কাছে আসছে। তাদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। অনেক যুবক এরই মধ্যে মাছ চাষে সফলতা পেয়েছে।’ তিনি জানান, আগে পাঙাশের পোনা জেলার বিভিন্ন হ্যাচারিতে পাওয়া যেত। তবে বর্তমানে বগুড়া ও সান্তাহার থেকে আনতে হয়। দুই বছর ধরে করোনার কারণে পাঙাশ দেশের বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না। খাদ্যের দামও বেড়েছে। এ কারণে অনেক মৎস্যচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সখীপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীরণ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বেলায়েত একজন সফল মৎস্যচাষি ও সফল উদ্যোক্তা। তাঁকে দেখে অনেকেই মৎস্যচাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ২০২১ সালে বেলায়েত জেলার সেরা মৎস্যচাষি নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা প্রশাসক ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল হক গত সপ্তাহে বেলায়েতের কয়েকটি পুকুর সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।
জেলা প্রশাসক আতাউল গণি প্রথম আলোকে বলেন, বেলায়েত হোসেন মৎস্যচাষিদের জন্য আদর্শ। তিনি দেশে ফিরে আর বিদেশে যাননি। এ দেশেই পরিশ্রম করলে যে সফল হওয়া যায়, সেটা প্রমাণ করেছেন তিনি। কীভাবে এত সফল হলেন, তা সরেজমিন পরিদর্শন করতে তিনি বেলায়েতের মৎস্য খামারে গিয়েছেন। পুকুরের মাছ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন।