ক্ষতিপূরণসহ বিচার দাবি পরিবারের, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন স্ত্রী

ঢাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হওয়া দন্তচিকিৎসক বুলবুল হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপুরণের দাবিতে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা সংবাদ সম্মেলন করেন। আজ দুপুরে বুলবুলের বাড়ির সামনে
ছবি: প্রথম আলো

সকাল নয়টা। দন্তচিকিৎসক বুলবুলকে হারিয়ে গোটা পাড়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাড়ির উঠানে বুলবুলের নিথর দেহ। মায়ের আহাজারিতে উপস্থিত সবার চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ। ঘরের ভেতর একমাত্র ছোট বোন লাভলী সামাদ কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে স্বজনসহ বুলবুলের বন্ধুরা শেষ দেখা দেখতে তাঁর বাড়িতে এসেছেন।

আজ সোমবার ভোরের দিকে তাঁর লাশ রংপুরের ভগিবালাপাড়ায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাদ জোহর ভগিবালাপাড়া মসজিদে জানাজা শেষে স্থানীয় রামপুরা কবরস্থানে বুলবুলের দাফন সম্পন্ন হয়। গতকাল রোববার সকালে ঢাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হন দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল।

কাঁদতে কাঁদতে মা বুলবুলি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ছেলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছে। ওর বাচ্চাদের জন্য দুধ কিনতে বলেছিল। রমজানে বাসায় আসবে বলে জানায়। রাত শেষ হওয়ার পর সকালে খবর আসে ছেলে খুন হয়েছে। কিছুই বুঝতে পারছি না, ছেলেকে কেন খুন করা হলো? পরিবারের খরচ চালানোর জন্য আমার এই ছেলেই ছিল। এখন আমাদের কী হবে?’

এদিকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে লাশ দাফনের আগে দুপুরে নিহত বুলবুলের বাড়ির সামনে স্কুলের ৯৭ ব্যাচের বন্ধুমহল ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এ সময় চেয়ারে বসা নিহত বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আখতারের কোলে দেড় বছরের ছোট সন্তান কাঁদছিল। তাঁর পাশে অন্য একজনের কোলে আট বছরের কন্যাশিশু নির্বাক বসেছিল। ছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। সংবাদ সম্মেলনে বুলবুলের খুনের সুষ্ঠু তদন্ত, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

এখন আমার কী হবে? সন্তানদের পড়াশোনাসহ পরিবার চলবে কীভাবে? পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন তিনি (স্বামী)। ভোরে বাড়ি থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি খুন হন। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। সরকারের কাছে এটাই আমার আকুতি।
শাম্মী আখতার, আহমেদ মাহী বুলবুলের স্ত্রী

সংবাদ সম্মেলনে মৌখিকভাবে জানানো হয়, বুলবুলের ফোনের কললিস্ট অনুসন্ধান করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে। প্রশাসন একটু খতিয়ে দেখলে আসল রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বুলবুল ঠিকাদারির কাজ করতেন। নোয়াখালীতে একটি বড় ঠিকাদারির কাজের জন্য বুলবুল ভোরে বাড়ি থেকে বের হন। দুর্বৃত্তরা আগে থেকেই সেটি জানত। সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন নিহত বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আখতার, মামা আমিনুল ইসলাম ও বন্ধু আল আমিন।

বুলবুলের স্ত্রী শোকে কাতর হলেও পরিবারের সন্তানদের নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘এখন আমার কী হবে? সন্তানদের পড়াশোনাসহ পরিবার চলবে কীভাবে? পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন তিনি (স্বামী)। ভোরে বাড়ি থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পর খবর আসে, তিনি খুন হয়েছেন। এটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। সরকারের কাছে এটাই আমার আকুতি।’

আরও পড়ুন

দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল দিনাজপুরে বিয়ে করেন। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাঁর আট বছরের মেয়ে আহমেদ আফনা নাউন ও সামি নামে দেড় বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান আছে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর গাফফার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার সকালে বুলবুলের মৃত্যুর খবর জানতে পারি। বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। তিনি (বুলবুল) এলাকায় সবার অত্যন্ত পরিচিতজন। কারও সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি। কিন্তু তিনি ঢাকায় খুন হলেন। বিষয়টি ভাবতে অনেক কষ্ট লাগছে। তাঁর আর দেখা হবে না।’ অপরাধী যে–ই হোক, তিনি তাদের বিচার চেয়েছেন।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে, দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ। তিনি সেনাসদস্য ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি মারা যান। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় বুলবুল। ১৯৯৭ সালে রংপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৯৯ সালে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি ঢাকায় চলে যান। সেখানে মগবাজারে একটি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি মগবাজারে রংপুর ডেন্টাল নামে একটি চেম্বার খুলে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতেন। শুধু স্বাবলম্বীদের কাছ থেকে ফি নিতেন। এর বাইরে তিনি কয়েক বছর থেকে ঠিকাদারির কাজ করতেন।