কুয়াকাটায় ভেসে এল আরেকটি মৃত ওলিভ রেডলি কচ্ছপ

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে মঙ্গলবার সকালে পাওয়া যায় মৃত এই ২৫ কেজি ওজনের ওলিভ রেডলি কচ্ছপটি
ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের তেত্রিশকানি এলাকায় দুই দিনের ব্যবধানে আরও একটি বিশালাকৃতির মৃত ‌‘ওলিভ রেডলি কচ্ছপ’ পাওয়া গেছে। আজ মঙ্গলবার সকালের জোয়ারে ভেসে আসা কচ্ছপটি ২৫ কেজি ওজনের। একই জায়গায় গত রোববার সকালে একই ধরনের আরও একটি মৃত কচ্ছপ পাওয়া যায়। ২০ কেজি ওজনের আগের কচ্ছপটি ছিল পুরুষ, এবারেরটি স্ত্রী।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)  ওলিভ রেডলি কচ্ছপকে ‘সংকটাপন্ন’ প্রজাতির কচ্ছপ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিম পাড়ার জন্য কচ্ছপ সৈকতের কাছাকাছি এসে থাকে। তখন হয়তো জেলেদের জালে আটকা পড়ে কচ্ছপগুলো মারা যেতে পারে। তা ছাড়া কয়েক দিন আগে কুয়াকাটা, গঙ্গামতি সৈকতসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচুর জেলিফিশ জোয়ারের পানিতে ভেসে এসে আটকা পড়েছে। সমুদ্রের পানিতেও ওই সময় প্রচুর জেলি ফিশ ভাসছিল। কচ্ছপ জেলিফিশ খায়। তখন জেলেদের আঘাতে বা বিষাক্ত কিছু খেয়েও কচ্ছপ মারা যেতে পারে।

কুয়াকাটা আশার আলো জেলে সমবায় সমিতির সভাপতি নিজাম শেখ বলেন, এখনই যে কেবল মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে, তা নয়। বছরের প্রায় সময়ই জেলেদের জালে মৃত কচ্ছপ ধরা পড়ে। জোয়ারেও মৃত কচ্ছপ এসে আটকা পড়ে। প্রতিটি কচ্ছপই বড় আকারের। এগুলো সামুদ্রিক কচ্ছপ হিসেবে পরিচিত।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে গত রোববারও ভেসে আসে মৃত ২০ কেজি ওজনের ওলিভ রেডলি কচ্ছপ
ছবি: প্রথম আলো

কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর মৎস্য বন্দরের কয়েকজন অসাধু ট্রলার মালিক তাঁদের ট্রলারে ট্রলিং জাল (ধ্বংসাত্মক বেহুন্দি জাল প্রকৃতির) ব্যবহার করে থাকেন। এসব জাল সমুদ্রে ফেলার জন্য ট্রলারে ক্রেনের মতো থাকে। তা দিয়ে ট্রলারের দুই পাশে এসব ট্রলিং জাল মাছ ধরার জন্য সাগরবক্ষে ফেলা হয়। ট্রলিং জালে সামুদ্রিক কচ্ছপ, ডলফিন, হাঙর ও অন্যান্য অজস্র সামুদ্রিক প্রাণী আটকা পড়ে মারা যায়। এসব স্থলভাগে বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় তা সাগরেই ফেলে দিয়ে আসেন ট্রলিং জাল দিয়ে মাছ ধরা জেলেরা।

মঙ্গলবার পাওয়া যাওয়া কচ্ছপটির ছবি পাঠানো হয় বরিশালের মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক কামরুল ইসলামের কাছে। ছবিটি দেখে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে এই কচ্ছপের বর্ণনা দেন তিনি।

প্রথম আলোকে কামরুল বলেন, সামুদ্রিক কচ্ছপ-সম্পর্কিত তথ্য পর্যালোচনা করে বলা যায়, সমুদ্রে সাত শ্রেণির কচ্ছপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ওলিভ রেডলি, গ্রিন ও হক্সবিল শ্রেণির কচ্ছপ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পাওয়া যায়। বেশি পাওয়া যায় ওলিভ রেডলি শ্রেণির কচ্ছপ। কুয়াকাটায় পাওয়া যাওয়া মৃত কচ্ছপের অবয়ব, শরীরের আকৃতি, ক্যারাপেসের গড়ন, লেজের আকৃতি ও রং দেখে ধারণা করা যায়, এটি ওলিভ রেডলি প্রজাতির কচ্ছপ (Olive Redly Sea Turtle)। এর বৈজ্ঞানিক নাম লিপিডোসিলাস ওলিভেসা (Lipidochelys Olivacea)। মরা কচ্ছপটির শরীর গোলাকার আকৃতির হওয়ায় এটা মা ওলিভ রেডলি কচ্ছপ বলে মনে হয়।

এই সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশের বাইরে এই ধরনের কচ্ছপ উষ্ণমণ্ডলীয় প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরে বসবাস করে। উষ্ণ আটলান্টিক মহাসাগরেও এদের দেখা মেলে। এরা সাধারণত সাগরের অগভীর অঞ্চলের ২২-২৫ মিটার গভীরতায় এবং উপকূল রেখা থেকে ১৫-২০ কিলোমিটারের ভেতর চলাচল করে থাকে। সর্বোচ্চ ৫০ কেজি পর্যন্ত এদের ওজন হয়। মাথা থেকে লেজ বা পুচ্ছ পর্যন্ত ৬১ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট পর্যন্ত হয়। ওলিভ রেডলি শ্রেণির কচ্ছপের প্রজননক্ষম হতে প্রায় ১৫ বছর সময় দরকার। এরা সর্বোচ্চ ৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

কামরুল আরও বলেন, এ ধরনের কচ্ছপের প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর, তবে নভেম্বর সর্বোত্তম প্রজননের সময়। এরা চিংড়ি, লবস্টার, শামুক, ঝিনুক, ওয়ারম, জেলিফিশ, মাছ ও মাছের ডিম, সাপ ও শৈবাল-জাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। ওলিভ রেডলি শ্রেণির কচ্ছপ সাগরের অগভীর অঞ্চলে বসবাস করার কারণে সামুদ্রিক শৈবালের শরীরে এঁটে যায়, তাই গায়ের রং সবুজাভ বা জলপাই হয়। কুয়াকাটায় পাওয়া মৃত ওলিভ রেডলি শ্রেণির কচ্ছপ দুটি কোনো মাছ ধরা জেলের জালে আটকে মারা যেতে পারে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, কুয়াকাটায় একের পর এক সামুদ্রিক প্রাণীর মরদেহ ভেসে আসার খবর তাঁরা পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সামুদ্রিক প্রাণিসম্পদ রক্ষায় জেলেদের সচেতন করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৃত কচ্ছপ দুটির নমুনা সংগ্রহ করে বন অধিদপ্তরের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মৎস্য বিভাগ অবৈধ ট্রলিং জালসহ ট্রলার আটক করার জন্য প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে আসছে।