করোনায় থেমে গেছে দোতারার টুংটাংও
দিনাজপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির মাঠে খড়ের ছাউনির তৈরি গোলঘরটি একসময় কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের আড্ডায় মুখর থাকত। এটির পাশ দিয়ে গেলে কখনো শোনা যেত আবৃত্তি। কখনো কানে ভেসে আসত একতারা, দোতারার টুংটাং। কিন্তু করোনায় গোলঘরের সেই আড্ডা আর নেই, নেই দোতারার টুংটাং। কয়েক দিন আগের বৃষ্টিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে ঘরটিও।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গোলঘরটিতে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আড্ডা জমত। হয়তো সকালে আবৃত্তি হলে, বিকেলে পাঠচক্র। তবে সপ্তাহে এক দিন শুক্রবার নিয়মিত বসত গানের আসর। কিন্তু করোনায় গোলঘরের সব ধরনের আড্ডা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে কয়েক দিন আগের বৃষ্টিতে ধসে পড়ে ঘরের ছাউনি।
গোলঘরটিতে যাঁরা গান করেন, তাঁরা নিজেদের মাটির কাঁসার শিল্পী বলে পরিচয় দেন। তাঁদের বেশির ভাগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কেউ ইজিবাইকের চালক, কেউ পানের দোকানদার, কেউ–বা হকার।
গোলঘরটিতে যাঁরা গান করেন, তাঁরা নিজেদের মাটির কাঁসার শিল্পী বলে পরিচয় দেন। তাঁদের বেশির ভাগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কেউ ইজিবাইকের চালক, কেউ পানের দোকানদার, কেউ–বা হকার। তবে আসর জমাতে তাঁদের জুড়ি নেই। তাঁদের গান শুনতে আসেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ।
মাটির কাঁসার শিল্পীরা জানান, এখানে ৩০ জনের বেশি নিয়মিত গানবাজনা করতেন। তাঁদের কেউ গান করেন। কেউবা হারমোনিয়াম বাজান, কেউবা ঢোল, জিপসি, বাঁশি, মন্দিরা, একতারা, দোতারা বাজান। তাঁদের অনেকেই জেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘খ্যাপ’–এর শিল্পী হিসেবে গিয়ে বাড়তি অর্থ আয় করতেন। কিন্তু এখন সবই বন্ধ।
মাটির কাঁসার সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই। ৯ বছর ধরে শিল্পীদের নিয়ে এখানে নিয়মিত আসর জমানোর কাজটি করছেন বাসুদেব শীল। তিনি পেশায় বাসের টিকিট মাস্টার। তিনি বলেন, মাটির কাঁসায় যাঁরা গানবাজনা করেন, তাঁরা মাটির শিল্পী, মাটিরই গান করেন। কিন্তু এখন এখানকার শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। গান গাইতে না পেরে তাঁদের মনের খোরাকও মিটছে না।
গোলঘরের গানবাজনার নিয়মিত দর্শক-শ্রোতার তালিকায় রয়েছেন দিনাজপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান জলিল আহমেদ। সম্প্রতি তাঁকে পাওয়া গেল শিল্পকলা চত্বরে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও মাটির কাঁসার শিল্পীরা স্বশিক্ষিত। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই শিল্পীদের মনের ক্ষুধা মেটাতে গোলঘরটি মেরামত করে দেওয়া দরকার।
একই দিন দুপুরে শিল্পকলার বাইরে টংদোকানি ও মাটির কাঁসার শিল্পী মিনু বয়াতির সঙ্গে আলাপরত অবস্থায় দেখা গেল আরেক শিল্পী ইজিবাইকচালক বাবুল হোসেনকে। বাঁশিওয়ালা হিসেবে বেশ নামডাক বাবুলের। তিনি বললেন, ‘অনুষ্ঠানাদি নাই, আয়রোজগারও বন্ধ। সকাল ৯টায় গাড়ি নিয়ে বাইর হছি, ৮০ টাকা ভাড়া মারিয়া বসে গল্প করোছি। রোদের তাপ, শরীরটাও ভালো নাই।’
অসচ্ছল শিল্পীদের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা মীন আরা পারভীন বলেন, শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় অসচ্ছল সাংস্কৃতিক সেবী হিসেবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দিনাজপুরের ৮৬ জন মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে ভাতা পান। এ ছাড়া করোনাকালে প্রথম ধাপে ৪০ জন শিল্পীকে এককালীন ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। শিল্পকলা একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের তহবিল থেকে ৬০ জন শিল্পীকে ১ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ঈদুল আজহার আগে ৯২ জন শিল্পীকে ৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম বলেন, ‘মাটির কাঁসার শিল্পীদের সম্পর্কে জানি। করোনাকালে বিভিন্ন সময় তাঁদের সহযোগিতা করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গোলঘরটি মেরামতসহ শিল্পকলা একাডেমির কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। সত্যিকারের শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করা হবে।’