করোনায় কটিয়াদীর ‘ঢাকের হাট’–এর ঐতিহ্যে ভাটা
মহাষষ্ঠীর প্রতিমার আসনে প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে বিসর্জন-দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতার সবখানেই ঢাকের বাজনা চাই-ই চাই। পূজার প্রধান অনুসর্গ ঢাকের চাহিদা মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রতিবছর বসে ‘ঢাকের হাট’। ব্যতিক্রমী এই হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের পূজারিরা ওই হাটে গিয়ে দরদাম করে ঢাকিদের আমন্ত্রণ জানান। রীতি অনুযায়ী, হাট বসে দুদিন। পঞ্চমী ও ষষ্ঠী হাটবার। ঢাকি ও পূজারিদের পদচারণে এই দুদিন হাটস্থল পৌর শহরের পুরানবাজার এলাকা উৎসবের মাত্রা পায়। এক কথা হাটটি সব ধর্মের স্থানীয় মানুষের কাছে ঐতিহ্যের অংশ।
গত রোববার ছিল পঞ্চমী। রীতি অনুযায়ী রোববার থেকে হাট শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু আগের দিন থেকেই হাটে ঢাকির দল আসতে থাকে। রোববার গিয়ে দেখা যায়, এক যুগের মধ্যে এবারই ঢাক, ঢাকি ও পূজারি—সবই কম। আয়োজকদের ধারণা, করোনা পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঢাকের হাটেও। সেই কারণেই হাটের চিরচেনা রুপে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। এই নিয়ে আয়োজকদের মন ভালো নেই।
নিহার রঞ্জন বণিক ‘ঢাকের হাট’ কমিটির একজন সদস্য। রোববার হাটে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, হাটে এসে দরদাম করে মণ্ডপে ঢাকিদের আমন্ত্রণ জানানোর আনন্দ অন্য রকম। কিন্তু করোনায় আনন্দে ছেদ পড়েছে। অনেকে মুঠোফোনে ঢাকিদের সঙ্গে যুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এই কারণেই হাটে এবার ঢাক, ঢাকি ও পূজারি—তিনই কম।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কিছু সময় বিরতি দিয়ে কাঁসর, সানাই, নানা বাঁশি, করতাল ও খঞ্জরি নিয়ে ঢাকিরা দল বেঁধে বাদ্য বাজাচ্ছেন। পূজারিরা বিভিন্ন দলের কাছে গিয়ে বাদ্য বাজানো দেখছেন ও শুনছেন। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টায় রয়েছেন ঢাকিরা। বাজনার শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
একটি ঢাক দলের নেতৃত্বে আছেন দিলীপ কুমার ও নিতাই ঘোষ। দলের সদস্য ১৮ জন। এসেছেন বিক্রমপুর থেকে। এক লাখ টাকা চুক্তির অপেক্ষায় বাদ্য বাজিয়ে আর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে পূজারিদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তাঁরা। দিলীপ কুমার বলেন, ‘এবার পূজারি কম। প্রত্যাশিত চুক্তি না হলে বড় ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাব।’
আরেকটি ঢাক দলের নেতৃত্বে আছেন রতন চন্দ্র দাস। এসেছেন নরসিংদী থেকে। আশা সর্বনিম্ন ৮০ হাজার টাকা হলে চুক্তিবদ্ধ হবেন।
রতন চন্দ্র বলেন, ‘তিন ঘণ্টা ধরে হাটে আছি। দরদাম করতে কেউ এল না। হাট ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাঁর বিস্তর অভিযোগ। তিনি বলেন, হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের। আর সুবিধায় পিছিয়ে রয়েছে ৮০০ বছরের।’ এ বিষয়ে পৌরসভা পূজা উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, এই কথা ঠিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সুযোগ সুবিধার এতটুকু মিল নেই।
ঐতিহ্যের কথা জেনে এবার প্রথমবারের মতো হাটে এসেছেন ঢাকার গুলশান-২–এর কালা চাঁদপুর পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি কাঞ্চন কুমার দত্ত। হাট নিয়ে তাঁর অনুভূতি আকাশচুম্বি। কাঞ্চন কুমার বলেন, ‘হাটে এসে মনে হচ্ছে পূজা শুরুর আগেই পূজার আনন্দ অনুভব শুরু করেছি।’
ঢাকি ও পূজারিদের নানা অভিযোগ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতিশ্বর পাল বলেন, কোথায় কোনো অসঙ্গতি থাকলে অবশ্যই সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।