করোনাকালের নির্মমতা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনা পরিস্থিতিতে আমার সামনে ঘটে যাওয়া একের পর এক নির্মম ঘটনা আমার মনে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে, কে বেশি ভয়ংকর। কখনো মানুষের মৃত্যুকে পুঁজি করে লাভের চেষ্টা করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আবার কখনো দেখা যাচ্ছে, নির্মম আচরণের শিকার হচ্ছেন ডাক্তার ও ডাক্তারের পরিবারের সদস্যরা বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। কখনোবা এই পরিস্থিতিতে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পরও মারা যাচ্ছেন বিনা চিকিৎসায়। ঘটে চলেছে এমন অনেক নির্মম ঘটনা। কয়েকটি ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

একটি পরিবারের একজন সদস্যের কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে। ডাক্তার ওনাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে বলেন। এরপর শুরু হয় ওনার এবং ওনার পরিবারের সঙ্গে ভয়ংকর অত্যাচার। তাঁদের সঙ্গে সেই বাসার মালিক ও অন্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটেরা খুব খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। তাঁদের জানা ছিল না তাঁদের সঙ্গে এমন কিছু হবে। তাঁদের খাবার পর্যাপ্ত ছিল না। তাঁরা পাশের ফ্ল্যাট এবং বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করে তাঁরা মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাবে যাতে একটু বাজার এনে দেয়। কালকে থেকে বাসা লকডাউন হয়ে যাবে। কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন ও বাড়িওয়ালা জানান মানুষ পানি খেয়ে অনশন করে বেঁচে থাকে। আপনারাও তা–ই করেন। তাঁদের বাধ্য হয়ে ও এইভাবে থাকতে হলো কয়েক দিন।

কিন্তু মজার ব্যাপার ওই ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে তাঁর পরিবারের সদস্যকে দেখলে কিছু মানুষ দৌড়ে পালিয়ে যায় করোনায় আক্রান্ত হবেন এই ভয়ে। তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ করে, তাঁরা যেন ভয়ংকর অপরাধ করেছেন আর তাঁরা কোনো ভয়ংকর অপরাধীর পরিবারের সদস্য। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তারা মারা যাবে। এমন অমানবিক আচারণ যারা করে, সত্যি এরা মানুষ তো!

যারা নিজের ও সমাজের কথা ভেবে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে তাঁদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। আর যাঁরা আক্রান্ত হওয়ার পর গোপনে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সবার মধ্যে রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁদের সঙ্গে আমরা ভালো ব্যবহার করি। অপ্রিয় কথা হলেও এটাই আজ বাস্তবতা।

এরপরের ঘটনা মুদির দোকানে, জিনিসপত্র কিনতে গিয়েছি। একজন বললেন অনেক পুলিশ সদস্য কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হচ্ছেন। একজন বলে উঠলেন ভালো হয়েছে এরা ঘুষখোর। মনে একটা প্রশ্ন জাগল যাঁরা আজও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁদের ক্ষতি চাওয়া কি ঠিক?

আজও অনেকে এ আছে যাঁরা পুলিশের পোশাক পরিধান করেছেন দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে। আর এরা সংখ্যায় বেশি বলে। আজও আমরা শান্তিতে বসবাস করছি। আজকে এসব অদ্ভুত কথা ভাবতে বাধ্য করছে, যাঁরা মানুষের ভালোটা চাচ্ছেন না, এরা মানুষ তো!

এরপরের ঘটনাটা আমাকে সত্যি অবাক করে দিয়েছে। আমার এক বন্ধু ভ্যান চালানোর কাজ নিতে চাচ্ছে। একজন লোক আমি ওর সামনে যাওয়ার আগে বলতে শুরু করলেন, দেখে তো ভদ্র ঘরের, ভালো ছাত্র মনে হয়। ভ্যান চালাবে নেশার টাকার জন্য মনে হয়। আমার সেই বন্ধুর চোখটা ছলছল করে উঠল। আমি শুধু মনে মনে একটা জিনিস ভাবলাম যে ছেলে মাদক গ্রহণ করে সে টাকার জন্য চুরি, ছিনতাই করে, এসব করবে। সে রোদে পুড়ে কষ্ট করে ভ্যান চালাবে না। লোকটা দেখে মনে হলো উনি বড় কোনো অফিসে চাকরি করেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশা জন্য অপেক্ষা করছেন। হতে পারে অনেক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু তাঁর সাধারণ জ্ঞান কম। নয়তো মানুষের দুঃখ–কষ্ট নিয়ে মজা করে কেন আনন্দ লাভ করবেন। কিন্তু ছেলেটার ভাগ্য খারাপ। ভ্যানের মালিক তাকে ভ্যান চালানোর জন্য ভ্যানটা ভাড়া দিলেন না।

বলেন বাবা তোমরা শিক্ষিত মানুষ। তোমাদের দ্বারা এসব হবে না। পরে আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কাহিনি কী?
কেন এমন পদক্ষেপ?

বন্ধু জানাল ওর বাবা এক পাবলিকেশনে চাকরি করত। অফিসও ২৬ মার্চের দুই দিন আগে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। খোলে আবার সরকারের কথামতো মে মাসে। কিন্তু বয়স্ক লোকদের থেকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই লজিক দেখিয়ে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁকে তো এপ্রিল মাসের বেতন দেয়নি। তাঁকে জোর করে মিথ্যা স্বাক্ষর রাখা হয় কাগজে। অসুস্থতার জন্য নিজের ইচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে। যদি স্বাক্ষর করে তবে তাঁকে মার্চ মাসের বেতন দেওয়া হবে। এই দিকে বাসা ভাড়া বাকি দুই মাসের। বাড়িওয়ালা টাকার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছেন, পানি বন্ধ করে দেন মাঝেমধ্যে। আর পানি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে গেলে বলে এত দামি ফ্রিজ রেখে কী হবে। যদি সেখানে পানি রাখার পানিটাই না থাকে। বাবার বাধ্য হয়ে মিথ্যা কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়। বড় ভাই এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ছোট কাজ করতে তার লজ্জা লাগে। বড় বোন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি। তারপরও দিদি আর ওর জামাইবাবু লকডাউন সময় থেকে বারবার টাকা পাঠিয়ে চলেছে। কিন্তু এইটা আর কত দিন। এভাবে বোনকে চাপ দেওয়া ঠিক না। বড় ভাই সম্মানের জন্য কাজ করতে পারবে না, তারপর বোন যতই বারবার বলুক আমি তোদের সঙ্গে আছি তারপরও এইভাবে কত দিন। তাই মাঠে নেমেছি নিজে কিছু করার জন্য। আরও কয়েকটা টিউশন খুঁজে চলেছি।

বন্ধুর সব কথা শোনার পর মনে হলো মালিকপক্ষ আজ ভালোই আইন শিখেছে। সরকার বলেছে এই সময় কাউকে বরখাস্ত করা যাবে না। সুন্দর বুদ্ধি বের করেছে। কাগজে লেখা থাকবে, আমি অসুস্থতার জন্য চাকরি থেকে অব্যাহতি নিচ্ছি। আইন মালিককে কিছু বলতে পারবে না। আমার মনে একটাই কৌতূহল এমন বিপদের সময় এসব বুদ্ধি করে তো বেঁচে যাবেন হয়তো দেশের আইনের থেকে, সৃষ্টিকর্তার আইনের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন তো?

তবে ওর শেষ কথা আমার মনকে নাড়া দিয়ে ওঠে, ও বলে আজকাল যখন শুয়ে থাকি সিলিং ফ্যানে নিজেকে দেখতে পাই। হয়তো এই করোনা পরিস্থিতিতে অনেক ছাত্রের জীবন নষ্ট হয় যাবে চারপাশের কিছু মানুষের জন্য।
এখন আমি সর্বশেষ ঘটনা লিখতে চলেছি, যা আপনাদের ভাবতে বাধ্য করবে। এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে। লকডাউনে গাড়ি পাচ্ছি না। মেডিসিন কিনে বাসাতে আসছি। তাড়াতাড়ি বাসাতে আসার জন্য একটা গলি দিয়ে আসতে থাকলাম ভয়ে ভয়ে। অপরিচিত গলি হঠাৎ একটা বাসাতে দেখতে পেলাম দুপুরের খাবারের পর আবর্জনাগুলো রাস্তার পাশে ফেলছে। হঠাৎ একটা কুকুর সেই আবর্জনা খেতে শুরু করেছে। কুকুরটা হাড়জাতীয় কিছু মুখে নিয়েছে, তার মুখে ছোট একটা ইটের টুকরো ছুড়ে মারল। হাড়টা কুকুরের মুখের থেকে পড়ে গেল। মেয়েটি বলতে থাকল, এখন লকডাউন সবাই বাসাতে তোকে আর আমাদের বাসা পাহারা দিতে হবে না, তোর খাবার বন্ধ। এই নিষ্ঠুরতা আমাকে শিউরে তোলে। হয়তো আপনাদের কতটা নাড়া দেবে আমি জানি না।

সেই দিনের ঘটনা আমার মনে পড়লে দেহের লোমগুলো শিউরে ওঠে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। এ কেমন নির্মমতা এক নিরীহ প্রাণীর সঙ্গে। ও কথা বলতে পারে না, এইটা ঠিক। কিন্তু ওরও রয়েছে মানুষের মতো ক্ষুধা-তৃষা, যন্ত্রণা রয়েছে। কুকুরটার চোখ জলে ভেজা। হয়তো ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। কুকুরটা ক্ষুধার্ত ছিল অনেক। আর আমি তা বুঝতে পারি ১০ টাকায় ১১ পিস পাউরুটি কুকুরটাকে আমি খাওয়ানোর পর। ও যখন আমার কাছে আরও খেতে চায়। আমি আবার আরেকটা পাউরুটি প্যাকেট কিনি যার অর্ধেকও খেয়ে ফেলে। আর একটা মুখে নিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। সারা রাস্তায় একটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে যে খাবারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন, সেই খাবারটা একটা কুকুর খেলে কী সমস্যা। আর সে তো আপনার বাসা পাহারা দিয়েছে।

কুকুরের প্রতি এই নির্মম আচারণ করাটা কি খুব ভালো কাজ। যাঁরা এমন নির্মম আচারণ করেন এঁরা মানুষ তো!

আজ আমাদের মনমানসিকতায় করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর ভাইরাস বাসা বেঁধেছে। আমাদের উচিত এই বিপদের সময় নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

আর নিজের মনমানসিকতায় যে ভয়ংকর ভাইরাস জন্ম নিয়েছে, সেই ভাইরাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এই ভাইরাস করোনার চেয়েও মহামারি। মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি না করে বরং ভোরের স্বপ্ন দেখুন। যেদিন সূর্য উঠবে আনন্দের বার্তা নিয়ে, খবরের প্রথম পাতায় থাকবে না মৃত্যুমিছিলের কথা, থাকবে না কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
খবরের প্রথম পাতায় থাকবে,
আজ আমরা জয় লাভ করেছি
করোনাভাইরাসের বিপক্ষে।
সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সুস্থ থাকুন।

* শিক্ষার্থী, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ। [email protected]