কক্সবাজার জেলায় ভয়ংকর মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথের প্রথম চালান ধরা পড়ে ২০২১ সালের ৩ মার্চ। এরপর থেকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আইসের চালান আসা থামেনি, বরং বেড়েছে। ওই বছরে জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সব মিলিয়ে ২৩ কেজি ৮০২ গ্রাম আইস ধরা পড়ে। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় ৫০ কেজির বেশি আইস উদ্ধার হয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে প্রায় তিন কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী। ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এই নদী পেরিয়ে আগে শুধু ইয়াবা বড়ি প্রবেশ করলেও এখন পাল্লা দিয়ে আইসের চালান আসা বাড়ছে। বিভিন্ন সময় অভিযানে ভয়ংকর এসব মাদকের বাহকেরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতা ও মাদক কারবারির পৃষ্ঠপোষকেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে থামছে না মাদক ব্যবসা। উল্টো বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা কক্সবাজারে মাদক ব্যবসার বিস্তারের পেছনে পাঁচটি কারণের কথা বলছেন।
২৩ জুন গভীর রাতে নাফ নদী সাঁতরে বাংলাদেশের জলসীমানায় (খারাংখালী সীমান্ত) প্রবেশ করেন হাবিবুল্লাহ (৩৭) নামের এক ব্যক্তি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা তাঁকে আটক করেন। শরীর তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার ১ কেজি ৩৫৪ গ্রাম ওজনের ক্রিস্টাল মেথ বা আইস পাওয়া যায়। হাবিবুল্লাহর বাড়ি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারে। মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে আইসের চালানটি দেশে আনা হচ্ছিল বলে জানান টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার।
বিজিবি সূত্র জানায়, এর আগে ১৫ জুন রাতে নাফ নদী অতিক্রম করে দেশে আনার সময় হ্নীলা সীমান্ত থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা এবং ৪ কেজি ৩১৫ গ্রাম ওজনের আইসের বড় চালান জব্দ করে বিজিবি। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ৩০ মে রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ৪ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে বিজিবি।
কক্সবাজারে আইসের সরবরাহ বেড়ে গেলেও ব্যবহার তেমন হচ্ছে না। জেলার মাদকাসক্তদের ৯৫ শতাংশই ইয়াবা আসক্ত। আইসের চাহিদা এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় প্রায় ১ কোটি ইয়াবা এবং ৫০ কেজির বেশি আইস উদ্ধার করে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর মধ্যে শুধু বিজিবির অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৪২ কেজি আইস।
অন্যদিকে ২০২১ সালে উদ্ধার হয়েছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৫০ ইয়াবা ও ২৩ কেজি ৮০২ গ্রাম আইস। সে হিসাবে ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আইসের চোরাচালান। ২০১৯ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ। ২০১৮ সালে ১ কোটি ২৮ লাখ এবং ২০১৭ সালে প্রায় ৮৬ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়। একটি দেশ বা এলাকায় যত মাদক বিক্রি হয়, তার মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে বলে মত জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির।
বিজিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির কারখানা আছে ২৯টির বেশি। কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার সিংহভাগ পাচার হয় বাংলাদেশে। এখন মিয়ানমারের আইসের বাজারও বাংলাদেশমুখী।
তিন বছর আগে কক্সবাজারে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮২ হাজার। এখন তা বেড়ে প্রায় ৯৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রুহুল আমিন। তিনি বলেন, কক্সবাজারে আইসের সরবরাহ বেড়ে গেলেও ব্যবহার তেমন হচ্ছে না। জেলার মাদকাসক্তদের ৯৫ শতাংশই ইয়াবা আসক্ত। আইসের চাহিদা এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক।
বিজিবি সূত্র জানায়, ১ জুন মিয়ানমারের মংডুতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর রিজিয়ন কমান্ডার পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন হয়। সেখানে বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজম-উস-সাকিব মিয়ানমার থেকে ব্যাপক হারে ইয়াবার সঙ্গে আইস পাচারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মাদক চোরাচালান বন্ধে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হস্তক্ষেপ কামনা করেন। জবাবে বিজিপির রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এইচটেট লুইন মাদক চোরাচালান বন্ধে মিয়ানমারের কঠোর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তবে মাদক পাচার থামেনি।
টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের কয়েকজন কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, আগে টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধের মাদক কারবারিদের মৃত্যুর খবরে মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা শঙ্কার মধ্যে থাকতেন পাঠানো মাদকের বিক্রয়মূল্য হারানোর ভয়ে। এখন বন্দুকযুদ্ধ থেমে যাওয়ায় মিয়ানমারের কারবারিরা বাকিতে ইয়াবা ও আইসের চালান ঠেলে দিচ্ছেন।
মাদক চোরাচালানিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ইয়াবা ও আইসের বড় বড় চালান ধরা পড়লেও নানা কারণে মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে করা মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় জেলার ১ হাজার ১৫১ জনের নাম আছে। এর মধ্যে টেকনাফেই ৯১২ জন। তালিকার শীর্ষ ৭৩ জন ইয়াবা কারবারির ৬৫ জন টেকনাফের। ইয়াবা কারবারিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ওই তালিকার শীর্ষ নামটি ছিল কক্সবাজার-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মাদক চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার পেছনে পাঁচটি কারণের কথা বলছেন। এগুলো হলো:
মিয়ানমারে বাকিতে পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা ও আইস। এর ফলে দেশে নতুন ক্রেতা সৃষ্টি হচ্ছে।
মাদক বিক্রির টাকা মিয়ানমারে পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমে, তা বন্ধের উদ্যোগ নেই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারির পাশাপাশি নতুন করে ব্যবসায় নেমেছে আরও কয়েক হাজার, তাদের শনাক্তকরণের উদ্যোগ নেই।
থানায় দায়ের হওয়া মাদক মামলাগুলোর তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই। মাদকের উৎস, পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এবং
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরকেন্দ্রিক মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণহীন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢুকছে আইসও। মিয়ানমারে বাকিতে পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা ও আইস। এর ফলে উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় নতুন কারবারি সৃষ্টি হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ও আইসের বড় চালান ঢুকছে। এর অন্যতম কারণ সীমান্তের কাছাকাছি দূরত্বে ৯ লাখ রোহিঙ্গার উখিয়ার আশ্রয়শিবিরগুলোর অবস্থান। রোহিঙ্গা শিবিরে মাদকের মজুত গড়ে পরে সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্যাম্পের শতাধিক প্রভাবশালী রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইস ও সোনা চোরাচালানের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গত এক বছরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে বিদেশি ভারীসহ দুই শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র, ২৫ লাখের বেশি ইয়াবাসহ প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে।
১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক বলেন, এখন ক্যাম্পে মাদকের বেচাবিক্রি তেমন নেই। তবে মাদক কারবারি ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে।