দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জেলা খুলনায় উপজেলা রয়েছে নয়টি। এর সর্বদক্ষিণের উপজেলা সুন্দরবনঘেরা সমুদ্র উপকূলবর্তী কয়রা। এই উপজেলার মোট আয়তন সুন্দরবনসহ ১ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৪১ বর্গকিলোমিটার এবং সুন্দরবন বাদে ২৬৩ দশমিক ১২ বর্গকিলোমিটার। উপজেলায় মোট ৭টি ইউনিয়ন ও ১৩৩টি গ্রাম রয়েছে। কৃষি, বন, চিংড়ি ও শ্রমনির্ভর অর্থনীতির এই উপজেলায় লোকসংখ্যা তিন লাখের ওপর। করোনাকালে এই জনপদজুড়ে জীবন-জীবিকায় তেমন প্রভাব না পড়লেও মানুষের জীবন লন্ডভন্ড হয়েছে আম্পানে। প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে চাষি, শ্রমজীবী আর প্রান্তিক মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ-কষ্টে পড়েছে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে তাঁদের কষ্টের চিত্র।
কয়রার দক্ষিণ ও পূর্ব পাশজুড়ে বেশির ভাগ এলাকা পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল সুন্দরবনের মধ্যে। খুলনা সদর থেকে উপকূলীয় এই উপজেলার দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সারা দেশকে কাবু করলেও এই এলাকার মানুষকে খুব বেশি প্রভাবিত করেনি। তবে ২০ মে আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পানে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে চারটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা। গত প্রায় দুই মাসেও ওই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখানকার বাসিন্দারা। ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা আর এবার আম্পান—কয়রাবাসীর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বারবার বাদ সাধছে প্রকৃতি।
উপজেলার জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। অথচ আম্পানে এবার কৃষি উৎপাদন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, খেতের শুকিয়ে যাওয়া গাছ তুলে আঁটি বেঁধে মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ২ নম্বর কয়রা গ্রামের ঢালী পাড়ার মোবারক মোল্লা। বজবজিয়া খালধার এলাকার ইটের রাস্তার ওপরই দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। মাথায় এগুলো কী জানতে চাইলে বেশ একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় তাঁর মুখ থেকে। বলেন, ‘বেগুনগাছ। বেশ তরতাজা আর ফলন ভালো হয়েছিল বেগুনের। কিন্তু আম্পান সব শেষ করে দিয়ে গেছে। নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ২০ দিনের মতো নোনাপানিতে ডুবে ছিল খেত। পানি সরে যাওয়ার পর গাছ মরে গেছে। এখন সেগুলো তুলে জ্বালানির জন্য বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।’
প্রায় এক বিঘা জমিতে বেগুনের চাষ করেছিলেন মোবারক মোল্লা। নদী থেকে তাঁর খেতের দূরত্ব কমপক্ষে পাঁচ কিলোমিটার। পুরো খেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেকটা হতাশ তিনি। দীর্ঘদিন নোনাপানি আটকে থাকায় তাঁর ওই জমিতে এক বছরের মধ্যে অন্য কোনো ফসল হবে কি না, তা জানেন না। আইলার পর প্রায় আড়াই বছর কোনো ফসল পাননি তিনি।
মোবারক মোল্লার সঙ্গে কথা বলার সময় কাঁধে মাছ ধরার জাল নিয়ে সেখানে হাজির হন আব্দুর রাজ্জাক গাজী। নিজের মাছের ঘের থেকে মাছ ধরে বাড়ি ফিরছিলেন প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি বয়সের ওই ব্যক্তি। ইটের রাস্তার যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, তার পাশেই বাড়ি। মরে যাওয়া বেগুনগাছ নিয়ে কথা হচ্ছে শুনেই তিনি তাঁর নিজের খেতের অবস্থা দেখতে ডেকে নিয়ে যান। বাড়ির মধ্যে ঢুকেই দেখা যায়, উঠোনের এক পাশে ভেঙে পড়া একটি ঘরের ধ্বংসাবশেষ তখনো মাটির ভিত্তির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। রাজ্জাক গাজী বলেন, তাঁর ঘরের ভিতগুলো কিছুটা উঁচু করে তৈরি করা। তারপরও জোয়ারের পানি ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। ২০ দিনের মতো নিয়মিত জোয়ার-ভাটার পানি আসা-যাওয়া করত। এ কারণে রান্নাঘরসহ দুটি ঘর পড়ে যায়।
উঠোন পার হলেই পুকুর। পুকুরের পানি কিছুটা কালো। পুকুরের চারপাশে লাগানো আম, পেয়ারা, মেহগনিসহ অনেকগুলো গাছ মরে গেছে। টিকে আছে কিছু নারকেলগাছ। পুকুরের এক পাশে ফসলের খেত। ওই খেতে তখনো মরিচ আর বেগুনগাছের শুকিয়ে যাওয়া ‘কঙ্কাল’ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝের কিছু জমি ফাঁকা। রাজ্জাক গাজী বলেন, ১৫ কাঠার ওই জমিতে মরিচ, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, মিষ্টিকুমড়া ও পুঁইশাক লাগিয়েছিলেন। কিন্তু নোনাপানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। নোনার কারণে অন্যান্য গাছও মরে যাচ্ছে। পুকুরে বেশ বড় বড় মাছ ছিল। কিন্তু প্রথম দিনই জোয়ারের পানিতে তা ভেসে গেছে। বিলে নিজের প্রায় ১৫ বিঘার মতো মাছের ঘের ছিল। ওই ঘেরে সাত লাখ টাকার মতো মাছ ছেড়েছিলেন। কিন্তু পানিতে ভেসে যাওয়ায় সেখানেও কোনো মাছ নেই। প্রতিবছর ওই জমিতে দুবার আমন ও বোরো ধান চাষ করতেন। নোনাপানির কারণে এ বছর কোনো ধান চাষ করতে পারবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নন তিনি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাজ্জাক গাজী বলেন, ‘আম্পানের ঝড়ে এলাকায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি যা হয়েছে, তা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায়। আইলার সময় যে ক্ষতি হয়েছিল, এবারের ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি। আইলার পর দীর্ঘ ১১ বছরে কিছুটা গুছিয়ে উঠেছিলাম। এরই মধ্যে আবার সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। বাইরে কিছু করার সক্ষমতা থাকলে ভিটেবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতাম। আম্পানের পর খুবই কষ্টে আছে কয়রার মানুষ।’
আম্পানের পর কয়রা সদরের প্রধান সড়ক ধরে দুটি অংশে বিভক্ত করা যায় কয়রা উপজেলাকে। সড়কের ওপর মাটি ও বালুর বস্তা দিয়ে উঁচু করে পানি আটকে দেওয়ায় উত্তর পাশে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে দক্ষিণ পাশের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে থাকা কলাগাছ, আম, কাঁঠাল, জাম, লিচুসহ প্রায় সব গাছই বিবর্ণ হয়ে মারা যাচ্ছে। নারকেল, তালসহ কিছু বড় গাছ এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে সেগুলো আদৌ টিকে থাকবে কি না, তা এলাকাবাসী জানেন না। অন্যদিকে পুকুরসহ বিভিন্ন নিচু এলাকায় জমে থাকা পানি কালচে হয়ে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিলের হাজার হাজার বিঘা জমি পড়ে আছে। আমন ধানের মৌসুম শুরু হলেও তা নিয়ে যেন মাথাব্যথা নেই কারও। আম্পানের ক্ষতি যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে ওই এলাকার মানুষকে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাঁধ ভেঙে পানিবন্দী হয়েছিল দেড় লাখ মানুষ। আংশিক ও সম্পূর্ণভাবে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৮ হাজার। তিন হাজার হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে আর চার হাজার হেক্টর মাছের ঘের তলিয়ে গিয়েছিল।
এখনো পানিবন্দী পাঁচ গ্রাম
কয়রা সদরের দক্ষিণ দিকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন। সদর থেকে ওই ইউনিয়নের দিকে চলে গেছে পিচঢালা একটি সড়ক। তবে আম্পানের পর দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে থাকায় ওই সড়কে আর পিচের অস্তিত্ব নেই। এখন সড়কটি দেখলে মনে হয় ইটের খোয়া বিছানো কোনো সড়ক সেটি। চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় ওই সড়ক দিয়ে আর উত্তর বেদকাশীতে যাওয়ার উপায় নেই। ৮ জুলাই বিকেলের দিকে বেশ কিছুটা ঘুরে অন্য পথ দিয়ে উঠি ওই ইউনিয়নের কাছারিবাড়ি বাজারের দক্ষিণ পাশে।
মূল সড়কে উঠতেই দেখা যায় কয়েকটি ভ্যান। তাতে অলস বসে আছেন চালকেরা। আশপাশের দোকানেও গা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় মানুষকে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই চারপাশে ঘিরে ধরেন অনেকেই। সবাই নিজেদের দুঃখের কথা বলতে চান। সড়কের ধারে পানি দেখিয়ে তাঁরা বলেন, এটা নদীর জোয়ারের পানি। ভাটার টানে তা সরে যাচ্ছে। আম্পানের পর থেকে এভাবেই চলছে প্রতিদিন। প্রায় দুই মাস ধরে গ্রামের মধ্য দিয়ে এভাবে জোয়ার-ভাটা খেলা করায় ঘরবাড়ি সব ভেঙে গেছে। খেতের সবজি, মাছের ঘের—সব নষ্ট হয়ে গেছে। নিয়মিত এমন জোয়ার-ভাটা হচ্ছে ওই ইউনিয়নের কাঠমারচর, কাঠকাটা, গাজীপাড়া ও কাশিরহাটখোলা গ্রামে।
আব্দুস সাত্তার নামের এক ভ্যানচালক বলেন, ‘আম্পানের পর সড়কগুলো খুবই খারাপ হয়ে গেছে। এ কারণে মানুষ কম চলাচল করছে। আগে যেখানে দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হতো, সেখানে এখন আয় হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। ওই টাকা দিয়ে কোনোরকমে চারজনের সংসার চালিয়ে নিচ্ছি।’ পাশের দোকানে বসে ছিলেন মো. শফিউল্লাহ। তিনি এসে বলেন, এলাকার অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। কিন্তু এখন এলাকায় কোনো কাজ নেই। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে এলাকার মানুষ অন্য কোথাও গিয়ে কাজ করতে পারছেন না। এ কারণে সবাই অলস বসে আছেন। মানুষের হাতেও এখন আর টাকা নেই। একসময় যাঁরা আর্থিকভাবে মোটামুটি ভালো অবস্থানে ছিলেন, তাঁদেরও এখন কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।
সেখান থেকে কথা বলার পর কিছুটা সামনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পশ্চিম পাশজুড়ে শুধু পানি আর পানি। যত দূর চোখ যায় শুধুই পানি। আর কোমরসমান ওই পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক। মোবাইলে ছবি তুলতে দেখে এগিয়ে আসেন আতিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। খুলনা নগরে বাড়ি আতিকুর রহমান ওই এলাকায় একটি প্রকল্পের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে আছেন প্রায় এক বছর ধরে। পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই বলেন, ‘মানুষ যে কত কষ্ট করে টিকে থাকে, তা কয়রার মানুষকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আম্পানের পর থেকে মানুষগুলো সব অসহায় হয়ে পড়েছে।’
তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখা গেল, ডুবে যাওয়া বাড়িঘরের পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে এল ছোট একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, তার কিছুটা উত্তর দিকে মূল সড়কেই ভেড়ে সেটি। চালকসহ চারজন ছিলেন তাতে। কাছে গিয়ে দেখা যায়, মধ্যবয়স্ক একজন ট্রলার থেকে আগের ঘরের আড়ার কাজে ব্যবহৃত কিছু কাঠ নামাচ্ছেন। জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ওই কাঠগুলো সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। আম্পানে নদীভাঙনে সেখানেও অনেক ঘর ভেঙে গেছে। কয়রার পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের অপর পারেই গাবুরা গ্রাম। দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
পিচঢালা ওই সড়ক ধরে আরও কিছুটা দক্ষিণে দিঘির পাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মূল সড়কের ওপরই প্রায় বুকসমান পানি। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে যত দূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। দূরে দূরে থাকা বাড়িগুলো যেন ওই পানির ওপর ভাসছে। ওই জায়গায় কয়েকটি ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। আম্পানের পর জোয়ারের সময় এখন সেটিই মানুষের গন্তব্যস্থলে যাওয়ার প্রধান মাধ্যম। সেখানে থাকা মাকসুদুর রহমান নামের একজন বলেন, দূরে যত বাড়ি দেখা যাচ্ছে, তার বেশির ভাগেই এখন কেউ বসবাস করছেন না। নিয়মিত জোয়ার–ভাটার কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।
কথা বলার ফাঁকে সেখানে আসেন মইফুল বেগম। বেশ দূরে নিজের বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘বাড়ি আছে, কিন্তু থাকার পরিবেশ নেই। জোয়ারে ঘরের মধ্যেই মাজাসমান পানি থাকে। গাবুরার মধ্যবিল এলাকায় নদীর পারে বাড়ি ছিল। আইলার সময় ওই বাড়িসহ সবকিছু নদীতে ভেসে যায়। পরে কাশিরহাটখোলায় থাকা বাপের বাড়ি এলাকায় ভাইদের সহায়তায় বাড়ি করেছিলাম। কিন্তু সেটিও ছাড়তে হয়েছে। এখন দিঘির পাড় এলাকায় অন্যের জমিতে বাঁশ, পলিথিন দিয়ে ঘর করে থাকছি।’
ওই এলাকায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই দেখা গেল, দূরে কেউ একজন বুকসমান পানি মাড়িয়ে হাতে কিছু নিয়ে সড়ক ধরে এগিয়ে আসছেন। কাছে আসতেই দেখা যায়, হাতে পলিথিনে মোড়ানো লুঙ্গি, গেঞ্জি, স্যান্ডেল ও মোবাইল। ইমন হোসেন নামের ওই তরুণ বলেন, ‘বাড়িতে যাঁরা থাকেন, সাধারণত জোয়ারের সময় তাঁরা বের হন না। আর যদি কারও বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হয়, তাহলে পলিথিনে লুঙ্গি-গেঞ্জি নিয়েই বের হতে হয়।’
পানির মধ্যে বেশ কিছুটা দূরে থাকা একটি বাড়িতে মানুষ বসবাস করছেন শুনে ওখান থেকে ২০০ টাকায় একটি নৌকা ভাড়া করে গেলাম দেখতে। গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়ি থেকে একটি ট্রলার বের হয়ে যাচ্ছে। উঠানের মধ্যেই প্রায় গলাসমান পানি। পাকা বাড়ির সিঁড়ির ওপর পর্যন্ত পানি উঠে গেছে, দরজা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। দরজার কাছে ছিলেন সালাউদ্দিন ইউসুফ নামের একজন। তিনি বলেন, ‘আম্পানের কয়েক দিন পর পর্যন্ত ঘরের মধ্যেই হাঁটুসমান পানি উঠেছিল। এখন পানি অনেকটা কমে গেছে। বাবা-মাকে বোনের বাড়িতে রেখে এসেছি। আমার তিন বছরের ছোট একটি বাচ্চা আছে। তাকে নিয়ে আতঙ্ক বেশি। বেশির ভাগ জোয়ারের সময় তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করি আমরা।’
বন বন্ধ, আয় বন্ধ
কয়রা সদরের পূর্ব দিকে ৬ নম্বর কয়রা গ্রাম। সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পিচঢালা পথ শেষ হয়েছে ওই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদীর ধারে। নদীর অপর পারেই সুন্দরবন। ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ বনজীবী। সন্ধ্যার কিছু আগে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটা বাজারের মতো জায়গাটিতে মানুষের আনাগোনা বেশি। রয়েছে কয়েকটি মুদি, কাপড় ও চায়ের দোকান। কেউ দোকানে, কেউ রাস্তার ধারে বসে গল্প করছেন।
এঁদেরই একজন মুজিবর মোড়ল। পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে মাছ ধরা ও মধু সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো নেই। সুন্দরবন বন্ধ, আয়ও বন্ধ। এলাকায় অন্য কোনো কাজ নেই যে সেটি করব। আগামী দুই মাস সংসার কীভাবে চলবে তা জানি না।’ মধ্য বয়স্ক মো. হিজবুল্লাহ হাওলাদার বলেন, বন বিভাগ থেকে সাত দিনের জন্য বনে মাছ ধরার অনুমতি দেয়। ওই সাত দিনে সব খরচ বাদ দিয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা থাকে। ১ জুন থেকে বনে প্রবেশের পাস (অনুমতিপত্র) দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত তা চলমান থাকবে। বন বন্ধ বলেই এত মানুষ এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। দুই মাস বসে থাকলে মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করে চলতে হবে।
ওই এলাকার সবচেয়ে বড় মুদিদোকান মো. শাহিনুর ইসলামের। জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনায় সবকিছু বন্ধ থাকলেও কয়রার অবস্থা ছিল স্বাভাবিক। এ কারণে বেচাকেনায় খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে বন বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে বিক্রি কমতে শুরু করেছে। প্রয়োজন না হলে মানুষ খুব বেশি টাকা খরচ করছেন না। আগামী দুই মাস এভাবেই যাবে।
দুই মাস পরও আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ
কয়রা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হরিণখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার। ২ নম্বর কয়রা গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি ইট বিছানো সড়ক চলে গেছে ওই গ্রামে। ইট বিছানো সড়ক হলেও আম্পানের পর পানিতে ডুবে থাকায় সড়কের অবস্থাও বেহাল। কিছু পথ মোটরসাইকেল ও কিছু পথ হেঁটে যাই ওই সাইক্লোন শেল্টারে।
তিনতলা ওই শেল্টারের সামনের অংশে কয়েকটি মাছ ধরার জাল শুকাতে দেওয়া। নিচতলায় রাখা নদীতে মাছ ধরার কয়েকটি বড় জাল, গরু, ছাগল ও খড়কুটা। দ্বিতীয় তলায় যেতেই দেখা যায়, কয়েক হাত জায়গা নিয়ে গাদাগাদি করে একেকটি পরিবার বসবাস করছে। শাড়ি ও চাদর দিয়ে ঢেকে নিজেদের কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। তৃতীয় তলায়ও একই অবস্থা। ওই সময় প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রান্নার আয়োজন চলছিল। দেখা যায়, সব পরিবারই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছে। গ্যাসের চুলাগুলোও নতুন।
একেক পাশে ৫-৬টি করে পরিবার রয়েছে। ওই তলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে দুটি ছোট খাট ফেলে ‘ঘর’ সাজিয়েছেন রিয়াসাদ মোল্লা। দুই খাটের মাঝখানের কিছুটা ফাঁকা জায়গায় রান্নার ব্যবস্থা। গত ৯ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে যখন যাই, তখন তাঁদের মাছ রান্নার আয়োজন চলছিল। স্ত্রীকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করছিলেন রিয়াসাদ। তিনি বলেন, ‘নদী থেকে মাছ ধরে নিয়ে এসেছি। এখন সেটা রান্না করা হচ্ছে। এলাকার প্রায় সব মানুষই দিনমজুর। আম্পানের পর থেকে কাজ না থাকায় সবাই নদীতে মাছ ধরে, কিছু বিক্রি করে চাল কেনে, আর কিছু পরিবারের খাওয়ার জন্য রাখে।’
রিয়াসাদের সঙ্গে কথা বলতে শুনে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের ‘ঘর’ থেকে বেরিয়ে আসেন মো. জামির হোসেন নামের এক তরুণ। খুলনা সরকারি বিএল কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। জামির হোসেন বলেন, তাঁদের পাঁচ বিঘার মতো ধানের জমি, তিন বিঘার মতো মাছের ঘের, ঘরবাড়ি—সবই ছিল। কিন্তু আম্পানে কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে ঘর, মাছের ঘের—কিছুই নেই। প্রতিবছর একবার করে আমন ও বোরো ধানের চাষ হতো। পরিবারের বছরের খোরাক রেখে দেওয়ার পর বাকিটা বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু আম্পানের সময় ঘর থেকে ধানসহ কোনো আসবাবই বের করে নিয়ে আসতে পারেননি। এখন আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে।
ওই আশ্রয়কেন্দ্রে ৪০টি পরিবারের প্রায় ২০০ জন বসবাস করছেন। মূল নদীর ভাঙন ঠিক না করায় হরিণখোলা গ্রামের ওই পরিবারগুলোর বাড়িতে এখনো নিয়মিত নদীর জোয়ার-ভাটা আসা–যাওয়া করছে। আগে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানান আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকেরা।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আম্পানের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেকে ঘরে ফিরতে পারেননি। হরিণখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার ও উত্তর বেদকাশীর দিঘির পাড় এলাকার বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলে এখনো শতাধিক পরিবার বসবাস করছে। এ ছাড়া কাঠমারচর ও কাশিরহাটখোলা এলাকায় বাঁধের ওপর রয়েছে আড়াই শতাধিক পরিবার।