‘আমি বাজানের মুখটা দেখবার চাই’
তাঁরা চারজন চাচাতো ভাই। তাঁদের স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা আনবেন। সেই উদ্দেশ্যে দালালের মাধ্যমে তাঁরা ইউরোপে যাচ্ছিলেন। নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। ওই চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত জয় তালুকদারের (২২) বাড়ি সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি এলাকায়। তাঁর বাবা পলাশ তালুকদার জয়ের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ঠান্ডায় প্রাণ হারিয়েছেন সাত বাংলাদেশি। বাংলাদেশ দূতাবাস ২৫ জানুয়ারি বিষয়টি জানতে পারে। ওই নৌকায় যাত্রী ছিলেন ২৮৭ জন। তাঁদের মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশি। অন্যরা মিসরীয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস এসব তথ্য জানিয়েছে।
জয়ের পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ নভেম্বর পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইবাড়ি থেকে জয় তালুকদার ও তাঁরই চাচাতো ভাই প্রদীপ তালুকদার (২১), মিঠু তালুকদার (২২), তন্ময় তালুকদারসহ (১৮) ছয় তরুণ ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাদারীপুর ছাড়েন। তাঁরা দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় প্রায় দেড় মাস বন্দী থাকেন। ২২ জানুয়ারি তাঁদের সাগরপথে যাত্রা শুরু হয়। ওই রাতে বাংলাদেশ, মিসরসহ বিভিন্ন দেশের ২৮০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় করে লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করেন। যাত্রা শুরুর এক দিন পরে ভূমধ্যসাগরে প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাসের পর টানা বৃষ্টি হয়। নৌকাটি ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছায়। পরে ইতালিয়ান কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাঁদের উদ্ধার করেন। এ সময় নৌকা থেকে সাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে জয়ও ছিলেন।
আজ শনিবার সকালে বড়াইবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জয়ের বাড়িতে গভীর নীরবতা। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আহাজারি করছেন মা লক্ষ্মী তালুকদার। ছেলের মুখ দেখার জন্য সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। সাগরপথে যাত্রা হওয়ার আগে ২২ জানুয়ারি সকালে জয়ের সঙ্গে তাঁর মায়ের মুঠোফোনে কথা হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে সবশেষ বলা কথা স্মরণ করে কেঁদে উঠছেন তিনি। বলছেন, ‘আমার বাজানে মরে নাই। ও কইছে, ইতালি গিয়া ফোন দিব। ওরে একবার ফোন দিতে কও। আমি বাজানের মুখটা দেখবার চাই।’
নিহত জয়ের বাবা পলাশ তালুকদার একজন কাঠমিস্ত্রি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জয় মেজ। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। যে কাম করি, তা দিয়া সংসার চলে না। দালাল জামাল আমাগো এলাকার। ও ইতালিতে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পরে ওরে বিশ্বাস কইরা ধারদেনা আর জমি বেইচা সাত লাখ টাকা জোগাড় করি। প্রথমে দালালরে ৫০ হাজার দিছি। পরে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরে সাড়ে ছয় লাখ দিছি। এতগুলা টাকা গেল, তবু যদি পোলাডা বাঁইচা থাকত, তাহলে দুঃখ থাকত না। আমাগো সব শ্যাষ হইয়া গেল। এহন মরণ ছাড়া আর কোনো গতি নাই।’
জয়ের কাকা গোবিন্দ তালুকদার বলেন, ‘আমার ছেলে প্রদীপ, ভাতিজা জয়সহ আমাগো বাড়ির চার ছেলে এই পথে ইতালিতে যায়। ওরা তিনজন কোনোমতে কষ্টে ইতালিতে পৌঁছালেও জয় পথেই মারা গেল। আমরা ছেলে প্রদীপ জয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাগো জানাইছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামাল খান বড়াইলবাড়ি এলাকার সোনমিয়া খানের ছেলে। ইতালিতে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে জামাল সাত লাখ টাকা করে নেন। জয়ের মৃত্যুর খবরের পর থেকে তিনি এলাকায় নেই। আজ সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়েও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে জামাল মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর থানায় মানব পাচার আইনে একটি মামলা রয়েছে। এই মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। প্রায় এক বছর আগে তিনি জামিনে মুক্ত হন।
পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লাভলু তালুকদার বলেন, ‘আমার এলাকায় কিছু দালাল আছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে। বিচার না হওয়ায় দালাল চক্র ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে কিছু টাকা আর ভয়ভীতি দেখিয়ে দালালেরা মীমাংসা করে নেয়। এ কারণে অবৈধপথে বিদেশযাত্রা থামছে না।’
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘ঠান্ডার কারণে ভূমধ্যসাগরে মৃত সাত বাংলাদেশির মধ্যে একজনের বাড়ি মাদারীপুর সদরে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাঁর পরিবারকে থানায় অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে মামলা নেওয়া হবে।’