নদীকৃত্য দিবস আজ
আবর্জনার ভাগাড় ময়ূর নদ
নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২০টির বেশি নালার মুখ ময়ূর নদের সঙ্গে যুক্ত। এতে বিষাক্ত হচ্ছে নদের পানি।
খুলনা নগরের অন্যতম প্রবেশদ্বারে গল্লামারী সেতু। সেই সেতুর ওপর দিয়ে নাক চেপে চলাচল করছে মানুষ। নিচের কালো রঙের পানি থেকে নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে উৎকট গন্ধ। সেতুর দুই প্রান্তে স্তূপ হয়ে আছে হরেক রকমের বর্জ্য। পাশের বা’ব-এ-সালাম সড়কের ওপর থেকেই দুই নারী বর্জ্য ফেলছেন। অদূরে নদের মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে ঘাস কাটছেন একজন।
খুলনা নগরের হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত ময়ূর নদের একটি অংশের খণ্ডচিত্র এটি। একসময়ের স্রোতস্বিনী নদটি এখন শ্রী ও গতি হারিয়েছে। প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
খুলনা নগরের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আগে রূপসা নদীর সঙ্গে ময়ূরের সরাসরি সংযোগ ছিল। এখন জলকপাটের (স্লুইসগেট) মাধ্যমে জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত। স্লুইসগেট বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। ফলে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
নদে সরাসরি বর্জ্য ফেলা ওই দুই নারীর একজন মরিয়ম বেগম বলছিলেন, ‘এক যুগ আগেও অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। এখন তো ভাগাড়ের মতো। পানি চলাচল নেই, ঘাস-লতাপাতা আর কচুরিপানায় ভরে গেছে। এখানে যেমন দুর্গন্ধ, তেমন মশা। পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। যদিও ঠিক নয়, তবে ময়লা ফেলার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সবার মতো আমরাও নদেই ময়লা ফেলি।’
গতকাল রোববার সরেজমিন দেখা যায়, গল্লামারী এলাকায় পাশাপাশি দুটি সেতুর নিচে রাশি রাশি বর্জ্য। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। গল্লামারী বাজারের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে স্থানটি। পাড়ে জন্মানো আগাছা একেবারে মাঝনদীতে চলে গেছে। নর্দমার আবর্জনাময় পানি এসে পড়ছে নদে। কচুরিপানায় ঢাকা নদের যতটুকু অংশে পানির দেখা মেলে, তা কুচকুচে কালো। সোনাডাঙ্গা এলাকায় ময়ূর সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায় শুধুই কচুরিপানা; এক ইঞ্চি জায়গায় পানির দেখা মেলে না।
পরিবেশ-সংশ্লিষ্টদের মতে, ময়ূরের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর বড় একটি কারণ নগরের নালা-নর্দমা। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২০টির বেশি নালার মুখ ময়ূর নদের সঙ্গে যুক্ত। এসব নালা-নর্দমার ময়লা-আবর্জনা বিষাক্ত করে তুলছে নদের পানি। অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতা, অপর্যাপ্ত পানিপ্রবাহসহ নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী নদটি ব্যাপক দূষিত হচ্ছে।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কম
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় প্রতি মাসে ময়ূর নদের তিনটি পয়েন্টে পানির যে দূষণমাত্রা পরীক্ষা তাতে এই নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মান সারা বছরই গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কম থাকে। গত ডিসেম্বরে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের পরীক্ষায় দেখা যায়, নদের পানিতে ডিও ছিল শূন্য। অথচ জলজ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য পানিতে প্রতি লিটারে পাঁচ মিলিগ্রাম বা তার বেশি ডিও থাকা প্রয়োজন। নদের পানিতে বিদ্যুৎ পরিবাহিতাও অনেক বেশি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ পরিবাহিতা প্রতি সেন্টিমিটারে ১ হাজার ৬৭৬ মাইক্রো সিমেন্স ছিল। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকলে এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বেশি থাকলে বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বেশি থাকে।
বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার পরিচালক সাইফুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, নদটি দূষণে মরণাপন্ন অবস্থা। ময়ূর নদ বাঁচাতে হলে একা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্ন সংস্থা ও জনসাধারণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
খনন করেও সুফল মেলেনি
ময়ূর নদ রক্ষায় অতীতে নানা পদক্ষেপের কথা শোনা গেছে। কয়েক বছর আগে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ময়ূর নদ খনন করা হয়েছিল। তবে সেই উদ্যোগ কাজে আসেনি। আবার ময়ূর নদ খননের উদ্যোগ নিয়েছে খুলনা সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি নদটি ঘিরে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পরিকল্পনা।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার বলেন, ‘নদটি খনন করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুই পাড় বাঁধাই করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা, মাঝেমধ্যে দুই পাড়ের সংযোগ সেতু করা, বিনোদনের জন্য নৌকা চালানোর ব্যবস্থা রাখা, পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের দুটি দাতা সংস্থা এবং সরকার এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ হয়ে যাবে।
ময়ূর নদ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ও বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, আগের বারের খনন কোনো কাজে আসেনি। নদটি নামকাওয়াস্তে খনন না করে ভালো করে খনন দরকার।