‘আগে দুইটা পরোটা খাইতাম, এখন একটা দিয়ে সারতে হচ্ছে’
খুলনার রূপসা নতুন বাজার লঞ্চঘাট মোড়ের ওপর একটি হোটেলে মানুষ সকালের নাশতা করছেন। হোটেলের ভেতরে বেশ কয়েক জায়গায় সাদা কাগজে বড় হরফে লেখা—‘০১/০৫/২০২২ ইং তারিখ হতে পরোটা প্রতি পিস ১০ টাকা’। অথচ গত মাসেও ওই হোটেলে ৫ টাকায় পরোটা পাওয়া যেত। সয়াবিন তেল, ময়দা, গ্যাস—তিনটারই দামই বেড়েছে। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়েই খাবারের দাম বাড়িয়েছেন বলে জানান ওই হোটেলের মালিক।
হোটেলের মালিক মো. নুরুল হক শিঙাড়া তৈরি ফাঁকে বলেন, ‘পরোটার পাশাপাশি শিঙাড়া–পুরিতেও ২ টাকা করে বাড়াতে হয়েছে। আগের ৩২ টাকা কেজির ময়দা এখন ৬০ টাকা। আর তেলের দাম তো কয়েক দিন পরপর বাড়ে। ৩০ কেজির এলপিজি গ্যাস কয়েক মাস আগে ২ হাজার ৮০০ টাকা ছিল। এখন সেটা ৩ হাজার ২৫০ টাকায় কিনলাম। এসবের পর পোষাতে গেলে তো দাম একটু বাড়তেই হবে, বলেন!’
হোটেলে নাশতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ইসরাফিল শেখ। স্থানীয় একটি মাছের আড়তে কাজ করেন। আলাপের মধ্যে নিজে থেকেই বলে উঠলেন, ‘ভাই, আগে দুইটা পরোটা খাইতাম, এখন একটা দিয়ে সারতে হচ্ছে। আয়ের ওপর দিয়ে তো চলতে হবে। তিনটা পরোটা আর এক বাটি ডাল মিলিয়ে ৪০ টাকা। যদি শখ করে একটা ডিম নেওয়া যায়, তাহলে তো হইলই! মাসে বেতনই পাই অল্প টাকা। সব মিলিয়ে ধরেন ডেইলি ২৫০ টাকা আয়। ওই টাকা আয় কইরে একবার নাশতা করলেই দিনের আয়ের চার ভাগের এক ভাগ টাকা নাই হইয়ে যায়।’
পাশে দাঁড়ানো ইসরাফিলের সহকর্মী মো. শাওন গাজী বলেন, ‘নাশতা তো গেলই। একটু-আধটু চা তো খেতে হয়। রুটি, কেক—সবকিছুর দাম বাড়ছে। ৫ টাকার বনরুটি এখন ১০ টাকা হইয়ে গেছে। এত সবকিছুর দাম বাড়লে পারা যায়!’
নূর আলম ইসলামও মাছের আড়তে কাছ করেন। ইসরাফিল–শাওনদের দেখে তিনিও এগিয়ে এসে আলোচনায় যোগ দেন। নূর আলম বলেন, ‘সংসার চালানোই কঠিন হয়ে গেছে। ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা বেতন। এর মধ্যে নাশতা করতেই যদি ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা চলে যায়, তাহলে আর টাকা দিয়ে মা খাবে কী, বউ-বাচ্চা খাবে কী! এ জন্য নাশতা করতিছি না। চা আর বিস্কুট খেয়ে নিচ্ছি।’
মাসে বেতনই পাই অল্প টাকা। সব মিলিয়ে ধরেন ডেইলি ২৫০ টাকা আয়। ওই টাকা আয় কইরে একবার নাশতা করলেই দিনের আয়ের চার ভাগের এক ভাগ টাকা নাই হইয়ে যায়।
ওই দোকানে খুব সামান্য তেল দিয়ে পরোটা ভাজছিলেন মনিরুল ইসলাম নামের এক কর্মী। তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ায় কম ব্যবহার করছেন। আবার বাজারে তেলও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। তাই খুবই অল্প তেলে পরোটা ভাজা শুরু করেছেন তাঁরা। তবে এভাবে ভাজতে গিয়ে অনেক সময় পরোটা পুড়ে যাচ্ছে।
শহরের নতুন বাজার এলাকাটি খুব সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাছের আড়ত, ডকইয়ার্ডের শ্রমিক আর লঞ্চঘাটে আসা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এখানে বেশ কিছু খাবারের হোটেল আছে। নিম্ন আয়ের এসব মানুষের দিনের বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে কেটে যায়। তাই কাজের ফাঁকে খিদে মেটাতে তাঁরা এসব হোটেলের দ্বারস্থ হন। তবে সম্প্রতি সয়াবিন তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম হোটেলে খাবারের দাম বেড়েছে। তাই সকালে নাশতা কিংবা দুপুরের খাবারের খরচ মেটাতে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছেন বলে জানা গেল।
নতুন বাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় নাছির হোটেলের সামনেও একই ধরনের নোটিশ ঝোলানো। হোটেলের মালিক মো. নাছির বলেন, তাঁর হোটেলে দুই রকমের পরোটা বিক্রি শুরু করেছেন। একটা ৮ টাকা করে, আরেকটা ৫ টাকা। দাম ঠিক রাখা হয়েছে। অনেক সময় ছোট বাচ্চারা অভ্যাসমতো এসে হাতে ৫ টাকা ধরিয়ে দিয়ে পরোটা চায়। তাদের জন্য পরোটার আকার ছোট করা হয়েছে।
নতুন বাজার ছাড়াও শহরের ময়লাপোঁতা, আহসান রোডসহ অন্যান্য হোটেল, রেস্তোরাঁতেও খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে। নগরের আহসান আহমেদ রোডের মিনি চাইনিজ কিং হোটেলে নোটিশে আবার দাম বাড়ানোর কারণ স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। ওই হোটেলের নোটিশে বলা হয়েছে, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে পরোটা ৭ টাকা’।
ওই হোটেলের কর্মী মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘বাজারের তেলের দাম কমলে আমাদের দাম আবার কমবে।’