আগুনে পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শিবিরে খাবার ও পানির সংকট
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী (ক্যাম্প-৫) আশ্রয় শিবিরে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রায় দুই ঘণ্টার আগুনে পাঁচ শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্তত তিন হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোলা আকাশের নিচে ত্রিপলের ছাউনির নিচে মানববেতর জীবন কাটাচ্ছে তারা। এ ছাড়া সেখানে খাবার ও পানির সংকট চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক রোহিঙ্গা জানান, গতকাল বিকেল পৌনে চারটার দিকে বালুখালী ক্যাম্প-৫-এর বি ব্লকের মোছরাবাজার এলাকার একটি রোহিঙ্গা পরিবারের রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই আগুন পুরো ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে আশ্রয় শিবিরের প্রায় ৫৫০টি ঘর পুড়ে গেছে। আগুনে পুড়ে মো. আয়াছ (৩) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে অন্তত ২০ রোহিঙ্গা নারী ও শিশু।
আজ বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের পর পুরো আশ্রয় শিবির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ওপর শুধু ইট–পাথরের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। সকালে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকে ছাইভস্ম সরিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুঁজে দেখছেন। কেউ কেউ ঘরের দখল ধরে রাখতে পুড়ে যাওয়া ঘরের ওপরই বসে আছেন।
ধ্বংসস্তূপের দক্ষিণ পাশে ছোট্ট একটি ছাউনির নিচে বসে আছেন রোহিঙ্গা গৃহবধূ সলেমা খাতুন (৩৫)। তিনি জানান, গতকাল বিকেলে তাঁর ঘর থেকে কিছুটা দূরে একটি ঘরে আগুন লেগেছিল। তখন হইচই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁর স্বামীও ঘরে ছিলেন না। পরে আশ্রয় শিবিরে ফিরে এসে দেখেন, তাঁর ঘরের সবকিছু পুড়ে গেছে।
সলেমা খাতুন বলেন, গতকাল রাতে ছেলেমেয়েদের বিস্কুট খাইয়ে ঘুমিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সকালে কলা আর পাউরুটি খাইয়েছেন। কিন্তু দুপুরের খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। আগুনে টাকাপয়সা পুড়ে যাওয়ায় দোকান থেকে কিছু কেনার মতো অবস্থাও নেই।
আরেক রোহিঙ্গা আবুল ফজল (৫৫) বলেন, তাঁর মতো অনেকেই এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সকাল থেকে তীব্র রোদ পড়েছে। কেউ কেউ দোকান থেকে ত্রিপল কিনে এনে অস্থায়ী ছাউনি দিয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষের কাছে খাবার ও পানি নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গৃহবধূ বলেন, আগুনে তাঁদের শৌচাগার ও গোসলখানা পুড়ে গেছে। অধিকাংশ নলকূপে পানিও আসছে না। এতে নারীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
বেলা ১১টার দিকে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজার নেতৃত্বে বিশেষ একটি দল ঘটনাস্থলে গেছে বলে জানা গেছে। দলটি শরণার্থী ব্যক্তিদের খাবার সরবরাহ, তাঁবু স্থাপন ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বসতবাড়ি তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এ ব্যাপারে তাঁরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা (আইওএম), বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বলে জানা গেছে।
মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। আজ দুপুরে তাঁদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। রাতেও রান্না করা খাবার ও পানি সরবরাহ করা হবে। আজকের বৈঠকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য জরুরিভিত্তিতে ২০০ তাঁবু স্থাপন, পুড়ে যাওয়া ঘরগুলো পুনর্নির্মাণ এবং আরও কয়েক দিন খাবার সরবরাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ছাড়া এবারের দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে এপিবিএন সতর্ক আছে।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং ৭ নম্বর শিবিরের কাঁটাতারের বাইরে উখিয়া-টেকনাফ সড়কের পশ্চিম পাশে অগ্নিকাণ্ডে ১০টি দোকান পুড়ে যায়। ৯ জানুয়ারি উখিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে তিন হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় হারিয়েছে। এ ছাড়া ২ জানুয়ারি উখিয়ার বালুখালী ২০ নম্বর শিবিরের জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত করোনা হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীতে আগুনে পুড়ে ১৫ রোহিঙ্গা মারা যায়। তখন ১০ হাজারের মতো ঘর পুড়ে ছাই হয়েছিল।