দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতির খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রোগ পরীক্ষার মূল সমন্বয়ের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর)। সমন্বয়ের কাজটি করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ। বর্তমানে আইডিসিআরে থাকা দেড় হাজারের বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষার ফল অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন থেকে অন্য ল্যাবরেটরির মান যাচাই করবে।
এদিকে আইইডিসিআরের নিজস্ব ল্যাবের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। মূল ল্যাবরেটরিও এখন সংক্রমিত। অথচ এত দিন আইইডিসিআর অন্য কোনো ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার কথা বলে এসেছে। মান ঠিক না থাকলে ল্যাবে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। আইইডিসিআরের মূল দায়িত্ব পরিবর্তন এবং সেখানে সংক্রমণের ঘটনার কারণ হিসেবে যথাযথ পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
>দেড় হাজারের বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষার ফল জানা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইইডিসিআর মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে ছিল। অভিযোগ ছিল, নমুনা সংগ্রহ ও ফলাফল জানাতে বিলম্ব হচ্ছিল তাদের।’ তিনি আরও বলেন, আইইডিসিআর আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবে না। অন্য ল্যাবরেটরির মান তারা যাচাই করবে। তারা করোনা নিয়ে রোগতাত্ত্বিক গবেষণা করবে। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নমুনা পাঠালে তবেই তা পরীক্ষা করবে।
শুরুতে আইইডিসিআর একাই নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে। আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার সকালে আইইডিসিআরের কোনো কর্মী ঢাকা শহরে বা আশপাশে নমুনা সংগ্রহে যাননি। প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরির একজন প্রধান ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত। একাধিক টেকনোলজিস্টও আক্রান্ত। বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নতুন করে কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীরসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা গত সপ্তাহে কোয়ারেন্টিন শেষ করেছেন। প্রায় দুই হাজার নমুনা জমে আছে, পরীক্ষার ফল জানাতে পারছে না আইইডিসিআর। যদিও প্রতিষ্ঠান এত দিন বলে আসছিল দিনে এক হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সামর্থ্য তাদের আছে।
আইইডিসিআর সব মানুষকে হয় ফোনে না হয় ই-মেইলে পরীক্ষার ফল জানাত। তারা এ কাজে দক্ষতা অর্জন করেছিল। আইইডিসিআরের কাজ এখন থেকে করবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষের কিছু কর্মকর্তা। এর নেতৃত্বে থাকবেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা।এই কাজে সহায়তার জন্য অবসরে যাওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (এমআইএস) সমীর কান্তি সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
গতকাল আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এমআইএসের সাবেক পরিচালক সমীর কান্তি সরকারের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি।’
গত জানুয়ারি থেকে করোনার কাজে যুক্ত আইইডিসিআর। বিদেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনা, তাঁদের কোয়ারেন্টিনে রাখা, নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষা—সবকিছুর সামনে ছিল আইইডিসিআর ও তার পরিচালক। নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংও করতেন পরিচালক। তিন দিন আগ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নমুনাও পরীক্ষা করেছে তারা। অনেকে মনে করেন, কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে পরীক্ষা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
জমে থাকা নমুনার ভাগ্য কী
গতকাল মীরজাদী সেব্রিনা স্বীকার করেছেন, তাঁদের কাছে জমে থাকা নমুনার সংখ্যা বাড়ছে। তবে তিনি পরিমাণ উল্লেখ করেননি।
ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সুস্থ হয়েছি কি না, তা জানতে পারব আইইডিসিআরের পরীক্ষার ফলাফল থেকে। তবে তারা তা জানাচ্ছে না।’
এ রকম দুই হাজার মানুষের নমুনা জমা আছে আইইডিসিআরে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ৫০০ নমুনার পরীক্ষা করবে আইইডিসিআর। বাকি দেড় হাজার নমুনা অন্য ল্যাবরেটরিতে ভাগ করে দেওয়া হবে।
এটা কীভাবে দেওয়া হবে, কবে দেওয়া হবে, তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। নতুন দায়িত্ব পাওয়া সমীর কান্তি সরকার বলেছেন, ‘কীভাবে কাজটি হবে, আমরা তার কৌশল ঠিক করছি। কৌশল ঠিক হলে মহাখালীর আশপাশের চারটি ল্যাবে এসব নমুনা ভাগ করে দেওয়া হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ল্যাবরেটরিগুলোর সূত্র বলছে, প্রতিটি ল্যাবেই পরীক্ষার চাপ। এসব নমুনা দ্রুত পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না। যেসব মানুষ এসব নমুনা দিয়েছেন, তাঁরা ফল কবে জানতে পারবেন, তা অনেকটাই অনিশ্চিত।
অসংগতি
করোনাভাইরাস দেশের ৬৩ জেলায় ছড়িয়েছে। রাজধানী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ অনেক বেশি। হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেবা নিয়ে মানুষের অনেক অভিযোগ আছে। এই সময় হঠাৎ করে রোগের পরীক্ষার দায়িত্বে বড় পরিবর্তনকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন জনস্বাস্থ্যবিদ বলেছেন, অপরিপক্বতার চূড়ান্ত উদাহরণ এটি। আইইডিসিআরের কারিগরিভাবে দক্ষ জনবল, উন্নত ল্যাবরেটরিসহ আরও নানা ধরনের সামর্থ্য আছে, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। কিন্তু পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে সেই সক্ষমতা এ সময় কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
আইইডিসিআরের নম্বরে ফোন করলে কর্মীরা বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতেন। এই ব্যবস্থাকে এতকাল যৌক্তিক বলে ব্যাখ্যা করে এসেছিল আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আইইডিসিআরে সন্দেহভাজন ব্যক্তি হাজির হলেও তাঁদের নমুনা নেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, এতে আইইডিসিআরে সংক্রমণ ঘটতে পারে। সেই যুক্তি থেকে সরে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তারা ঢাকা শহরে ৪০টি বুথ করবে বলে জানা গেছে। বাড়ির কাছের বুথে মানুষকে নমুনা দিতে যেতে হবে।
আইইডিসিআর বলেছিল, নির্দিষ্ট মানের (বিএসএল ২) ল্যাবরেটরি ছাড়া কাউকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে না। এক অজ্ঞাত কারণে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশকে (আইসিডিডিআরবি) নমুনা পরীক্ষা থেকে দূরে রেখেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু এখন দেশে ৩০টির বেশি ল্যাবরেটরিতে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে।
পরিকল্পনার অভাব
শুরু থেকেই অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্গে না নিয়েই করোনা মোকাবিলার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা ছাড়াই করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতির পরিকল্পনা তৈরি করেছে তারা। এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরও পরামর্শ নেওয়া হয়নি।
একটি পরিকল্পনা দলিলে ১১টি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। ৩ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় কমিটির সভায় ওই দলিল অনুমোদিত হয়। কিন্তু অনেকগুলো কমিটি কোনো কাজ করেনি। এমন অনেক কমিটি গঠিত হয়েছিল, যার কোনো সভাই হয়নি। এ নিয়ে সংবাদ ছাপা হয়। এরপর ওই দলিলের পঞ্চম সংস্করণে কমিটির সংখ্যা কমানো হয়। এরপরও দলিলে কারিগরি কমিটি ছিল, যার প্রধান ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
১৮ এপ্রিল জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আহ্বায়ক বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা। আর সদস্যসচিব আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। এর সদস্যসংখ্যা ১৭। সূত্র বলছে, এই কমিটি রোগ পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে, তা নিয়ে একটি পূর্বাভাস তৈরি করেছে। অন্য দিকে দেশের আটজন জনস্বাস্থ্যবিদ বেশ কয়েক দিন ধরেই পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের পূর্বাভাস ইতিমধ্যে প্রথম আলোসহ একাধিক গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকে বলে আসছে, সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে করোনা মোকাবিলা করতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা ও দেশের গণমাধ্যম সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে একত্রে কাজ করার ওপর জোর দিয়ে আসছে।
করোনা পরিস্থিতির আগে থেকে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব তথ্য দেওয়া হতো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে। প্রায় ১০ বছর ধরে এই কন্ট্রোল রুমের তথ্য গণমাধ্যমসহ অন্য অনেকে ব্যবহার করে আসছে। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে পৃথক কন্ট্রোল রুম খোলে আইইডিসিআর, তাদের নিজস্ব ভবনের নিচতলায়। দুটি কন্ট্রোল রুমের দূরত্ব ২০০ গজের কম। এর কিছুদিন পর রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা আরেকটি কন্ট্রোল রুম খোলে। সেটিও কাজ শুরু করে আইইডিসিআরে। আইইডিসিআর কন্ট্রোল রুম নিয়ে যায় ভবনের তিনতলায়। সমন্বয়হীনভাবে চলতে থাকে তিনটি কন্ট্রোল রুম। এরপর গত মাসের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নমুনা ভবনে করোনাবিষয়ক সমন্বিত কন্ট্রোল রুম খোলা হয়।
অনেকে মনে করছেন, আইইডিসিআর নিয়ে এখন যা হচ্ছে, তা আগে ঘটে যাওয়া সমন্বয়হীনতারই জের। অবশ্য মীরজাদী সেব্রিনা ও আবুল কালাম আজাদ দুজনেই তা অস্বীকার করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনাহীন ও সমন্বয়হীনতার অনেক নজির ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে এমন চলতেই থাকবে। মানুষের আরও ঝুঁকি বেড়ে যাবে।’