কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
অভিমত: ছাত্ররা প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব খাটালে বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কেমন করে?
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ঠিকাদারি দাবি করে ছাত্রলীগের নেতারা গতকাল বৃহস্পতিবার উপাচার্যের গাড়ি আটকে দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে ছাত্রলীগের নেতারা প্রথমে উপাচার্যের কক্ষে গিয়ে উচ্চবাচ্যও করেন। এ নিয়ে অভিমত জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ।
শুরু থেকেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিমুক্ত। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি শুরু করে ছাত্রলীগ। এককভাবেই তারা ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এরপর আস্তে আস্তে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে নেয়। নিয়োগ–বাণিজ্য, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষকেরা প্রশাসনিক কোন পদে কে বসবেন, তা ঠিক করে ছাত্রলীগ। এখন রাজনীতিতে যদি ছাত্ররা প্রবেশ করেন, তাহলে পড়াশোনার কী হবে? দেশে ছাত্ররা রাজনীতিতে এসে বদনাম অর্জন করছেন। এ অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। ১৫ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় বিকশিত হতে পারেনি রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে। সেখানে ক্যাম্পাসের ভেতরে–বাইরের বিবদমান পক্ষগুলো দায়ী।
খবরের কাগজ পড়ে যতটুকু জেনেছি, গত বৃহস্পতিবার চাকরি ও ঠিকাদারি কাজের জন্য উপাচার্যের গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। একজন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পূর্ণ হওয়ার দিন ছাত্রলীগ দল বেঁধে তাঁর গাড়ি আটকে দিল। যে দুই দাবির কথা দৃশ্যমান হলো, তা তো ছাত্রলীগের কাজ নয়। ছাত্রলীগ যদি লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রশাসনিক কাজে হাত দেয়, তাহলে তো বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। তাদের বিরুদ্ধে এখনই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সবকিছু করে দিচ্ছে। বর্তমান সরকার আরও বড় মেগা প্রকল্প দিয়েছে। এখানে তো ছাত্রলীগের কোনো কৃতিত্ব নেই। ছাত্রলীগকে কারা, কোন গোষ্ঠী পৃষ্ঠপোষকতা করছে, কারা কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য তাদের ব্যবহার করছে, সেটাও খুঁজে বের করতে হবে। ছাত্রজীবনে চাকরির জন্য উপাচার্যের পথ আগলে রাখা, ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার চেষ্টা করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। এভাবে যদি ছাত্ররা প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব খাটান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কেমন করে?
শুনেছি, শিক্ষকেরা কে কোন প্রশাসনিক পদে যাবেন, তার জন্য উপাচার্যের কাছে যাচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতারা। একজন শিক্ষক হিসেবে এটা আমার কাছে চরম অবমাননাকর। নিম্নমানের শিক্ষকেরাই ছাত্রদের এই ক্ষেত্রে লেলিয়ে দেন। এটা শিক্ষার লক্ষ্য নয়। শিক্ষা মানুষের মনকে উন্নত করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা দেশ গঠনে কাজে লাগে। মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ যা করছে, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো দাবি নয়। নিকট অতীতে ছাত্রলীগ এখানে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে মারধর, সিনিয়র–জুনিয়র মারামারি ছাড়া উল্লেখ করার মতো কিছু করেনি।
আমিও ছাত্রজীবনে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ভিপি (সহসভাপতি) ছিলাম। তখন আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতাম। কখনো টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ কিংবা ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিতে যাইনি। শিক্ষকদের কাছে মাথা নত করে থাকতাম। আর এখন শিক্ষক ছাত্রের কাছে মাথা নত করেন। নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ দিলে এমনই হবে। এখনো সময় আছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দাঁড়ানোর। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় চললে, ক্যাম্পাস চালাতে কোনো সমস্যা হবে না। আইন প্রয়োগ করুন। নব্বইয়ের দশকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে কোনো ছাত্ররাজনীতি নেই। কোনো হাঙ্গামা নেই। সেখানকার পড়াশোনার মান ভালো। কারণ, সেখানে ছাত্ররা খবরদারি করেন না। শিক্ষকেরা ক্লাস ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যতবার গিয়েছি, ততবারই তার নৈসর্গিক পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। লালমাই পাহাড়ের টিলার ফাঁকে ফাঁকে সুউচ্চ দালান। নানা প্রজাতির গাছগাছালি। এখানে এলে প্রাণ ভরে যায়। অথচ এই ক্যাম্পাসেও ছাত্রলীগ ছয় বছর আগে তার দলের লোককে মেরে ফেলেছে। এখানকার নেতৃত্বের হাতে রক্তের দাগ আছে। এই দাগ চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। সরকারকে এই উদ্যোগ নিতে হবে। গত এক দশকে ক্যাম্পাসের এই ছাত্রলীগের নেতারা কয়টা ভোট বাড়িয়েছেন। কয়জন ভোটারের কাছে গেছেন? কতজন নেতা ছুটিতে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে সরকারের উন্নয়ন কাজের কথা বলেছেন? সুতরাং তাঁদের লালন করে, আশকারা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি মন্থর করা ঠিক নয়। করোনার কাছে গত দুই বছর পড়াশোনা লাটে উঠেছে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি কম হয়েছেন। এখন সেশনজট কমাতে হবে। টানা ক্লাস–পরীক্ষা নিতে হবে। গবেষণা বাড়াতে হবে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগেরই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। এগুলোও ধামাচাপায় ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতা জড়িত। নেপথ্যে রয়েছেন কিছু কিছু শিক্ষকও। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চলতে দিন। সব অন্ধকার দূর করে কুমিল্লাবাসীর দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। আমি আশাবাদী মানুষ।
লেখক: অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ