অপরিকল্পিত বালুর বাঁধে ভাঙন তীব্র হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতের

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের ভাঙন ঠেকাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বালুভর্তি জিও টিউব ব্যাগের বাঁধ দিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন বিভিন্ন অংশ ফুটো হয়ে সৈকতে মিশে যাচ্ছে। গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো।

বেশ কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভাঙছে। গত কিছুদিনে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভাঙন আরও বেড়েছে। তৈরি হয়েছে বহু গুপ্তখালের। এ কারণে পর্যটকদের জন্য সৈকত যেমন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে, তেমনই হোটেল-মোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনাও ঝুঁকিতে পড়েছে। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে সৈকতের এমন ভাঙন বাড়তেই থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙান রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে। পাউবোর দেওয়া বালুর বাঁধের কারণে সৈকতের ভাঙন তীব্রতর হচ্ছে। সৈকতের একদিকে বালুর বাঁধ দিলে, অন্যদিকে দ্রুতই ভাঙন দেখা দিচ্ছে। তা ছাড়া জিওব্যাগ ভর্তি ওই সব বালুর বাঁধও টেকসই হচ্ছে না।

গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, সাগরে ঘন ঘন নিম্নচাপ লঘুচাপ-ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি কক্সবাজার সৈকতের জন্য বড় হুমকি তৈরি করেছে। তবে সমুদ্র শাসনের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যে বালুর বাঁধ দিচ্ছে, তাকে অপরিকল্পিত বলে অভিহিত করছেন গবেষকেরা। এমন বালুর বাঁধ সৈকতের ভাঙন আরও তীব্রতর করছে বলে তাঁরা মনে করেন।

সৈকতের ভাঙন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তিকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান। গতকাল মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বালুর বাঁধ দিয়ে সমুদ্র শাসন কিংবা ভাঙন রোধ করা মোটেও সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগও। ভাঙন রোধে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতে এ ভাঙন আরও তীব্র হতে পারে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ভাঙন বেশি হচ্ছে।

সমুদ্রের একূল ভাঙলে ওকূল গড়ে—প্রবাদ বচন উল্লেখ করে ড. শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজার সৈকতেও এমন নজির আছে। কিন্তু অপরিকল্পিত বালুর বাঁধ দিয়ে কিছুদিন ভাঙন রোধ করা গেলেও অন্যদিকের সৈকত বিলীন হচ্ছে। বালুর বাঁধও ভেঙে যাচ্ছে। বালুর বাঁধের পরিবর্তে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো স্থায়ী প্রতিরক্ষাদেয়াল তুলে সমুদ্র শাসন করা যায়। এ জন্য গবেষণা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আগস্টে ভাঙন বেশি

সমুদ্রবিজ্ঞানীদের অভিমত, প্রতিবছর আগস্ট মাসে সৈকতের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাচ্ছে। এ মাসেই বৈরী আবহাওয়ার কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ে। এই সময়ই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভেও ভাঙন দেখা দেয়। বালুভর্তি জিও-টিউব বাঁধ দিয়েও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।

গত ১৬ আগস্ট থেকে টানা সাত দিন কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ হয়েছিল। তাতে শহরজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা উপচে সৈকতের দিকে নেমে পড়ে। তাতে কলাতলী, সুগন্ধা ও সিগাল পয়েন্টে পাঁচ কিলোমিটার ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ভাঙনের কারণে সৈকতের একাধিক অংশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। তখন ট্যুরিস্ট পুলিশের দুটি চৌকি, শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি পণ্য বিক্রির শতাধিক দোকান বিলীনের ঝুঁকিতে পড়ে। ভাঙনের কারণে পর্যটকের হাঁটার জায়গাও সংকুচিত হয়ে পড়ে।

গতকাল সকাল ১০টায় কলাতলী সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক দিন আগে ভেঙে যাওয়া অংশটি এখনো সেভাবে পড়ে আছে। ভাঙা গর্তে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পাশের ৪৫টি দোকানের ঝিনুক মার্কেটের ৯০ শতাংশ বন্ধ। ভাঙার কারণে পর্যটকেরা সৈকতে নামতে অনীহা প্রকাশ করেন জানিয়ে ব্যবসায়ী আবুল বশর বলেন, ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

কলাতলীর উত্তরে সুগন্ধা পয়েন্টেরও একই অবস্থা। কয়েক দিন আগে বিলীন হওয়া অংশটি এখনো সেভাবে আছে। লাবণী পয়েন্টে ভাঙন জোয়ারের পানিতে মিশে গেলেও সেখানে আড়াই বছর আগে ভাঙন রোধে দেওয়া বালুর বাঁধ এলোমেলোভাবে পড়ে থাকায় পর্যটকদের হাঁটাচলায় সমস্যা হচ্ছে।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ভাঙন রোধে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। স্থায়ীভাবে সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে বিশেষ একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

কয়েক দশকেও এমন ভাঙন দেখা যায়নি

দীর্ঘ তিন যুগ ধরে সৈকত এলাকায় হোটেল ব্যবসা করছেন আবুল কাশেম সিকদার। তিনি কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি। আবুল কাশেম সিকদার (৬০) বলেন, গত ৪০ বছরেও সৈকতের লাবণী থেকে কলাতলী পর্যন্ত তিনি এমন ভাঙন দেখেননি। লাবণী পয়েন্টে বালুর বাঁধ দেওয়ার পর থেকে সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। দিন দিন ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এতে পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল এবং ৩ হাজার দোকানপাটের এই বিশেষ জোন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

পাউবো সূত্র জানায়, ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সৈকতে লাবণী পয়েন্ট থেকে উত্তর দিকে সমিতিপাড়া পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ওই সময় পূর্ণিমার জোয়ারে কয়েক হাজার ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছিল। বিলীন হয় ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি তথ্যকেন্দ্র ও কয়েকটি দোকান। ঝুঁকির মুখে পড়েছিল সরকারি কয়েকটি স্থাপনাসহ তিন শতাধিক দোকানপাট। ভাঙন ঠেকাতে তখন ৬৮ লাখ টাকা খরচ করে আড়াই কিলোমিটার বালুভর্তি জিওব্যাগের বাঁধ দেওয়া হলেও কয়েক মাসের মাথায় তার কয়েকটি অংশ ফুটো হয়ে বিলীন হয়।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে পূর্ণিমার জোয়ারের ধাক্কায় বিলীন হয়েছিল মেরিন ড্রাইভের টেকনাফ অংশের দুই কিলোমিটার। এ সময় বালুভর্তি প্রায় এক হাজার মিটার বাঁধ দেওয়া হলেও তা পরবর্তী সময় সরে গেছে। রামুর প্যাঁচার দ্বীপ সৈকতের ভাঙন রোধে পাউবো কয়েক কোটি টাকার বালুর বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও ভাঙন ঠেকাতে পারেনি।

গত ৫০–৬০ বছরে বালিয়াড়িতে এমন ভাঙনের নজির নেই জানিয়ে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, পাউবোর অপরিকল্পিত বালুভর্তি জিওব্যাগের বাঁধের কারণে সৈকতের আরও অংশ ভেঙে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ ও স্রোতধারা স্বাভাবিক নিয়মে চলে, বাধার সৃষ্টি হলে চালায় তাণ্ডব।

সমুদ্রের বিভিন্ন অংশে একাধিক গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, গত ১২ বছরে সমুদ্রে গোসলে নেমে অন্তত ৮৯ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর সুগন্ধা পয়েন্টের গুপ্তখালে আটকা পড়ে নিখোঁজ হন ঢাকার পল্লবী এলাকার কাজী জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে সজীব হোসেন (২৬)। এক দিন পর তাঁর মরদেহ ভেসে ওঠে তিন কিলোমিটার দূরের নাজিরারটেক সৈকতে।

পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী প্রজ্ঞান চাকমা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সমুদ্রের উচ্চ জোয়ার, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৈকত বিলীন হচ্ছে। ভারী বর্ষণের সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতেও সৈকতের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাচ্ছে। গত তিন বছরে ভাঙন বাড়ছে। ভাঙন রোধে লাবণী থেকে সমিতিপাড়া পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার বালুভর্তি জিওব্যাগের বাঁধ দেওয়া হলেও তা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।