ভূমধ্যসাগরে ডুবে শেষ দুই ভাইয়ের ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আরও একটু ভালো থাকার স্বপ্ন পূরণের জন্য অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার জন্য এক দালালকে টাকা দিয়েছিলেন দুই ভাই। কিন্তু ইতালি যাওয়া আর হয়নি তাঁদের। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান তাঁরা। এ ঘটনা চার মাস আগের। তাঁদের মৃত্যুর খবর গতকাল মঙ্গলবার পৌঁছে তাঁদের বাবা–মায়ের কাছে। দুই ছেলেকে হারিয়ে আহাজারি করছেন তাঁরা। দুই ছেলের মৃত্যু কিছুতেই তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না।
মারা যাওয়া ওই দুজন হলেন মিলন মুনশি (৩৫) ও আল-আমিন মুনশি (৩৩)। তাঁরা মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের পুয়ালী এলাকার সিরাজ মুনশি ও মায়া বেগম দম্পতির সন্তান। সিরাজ মুনশির এলাকায় একটি রেস্তোরাঁ আছে।
স্বজন ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, মিলন মুনশি দেড় বছর আগে তাঁর নিজ এলাকায় একটি মুদিদোকান দেন। তাঁর ছোট ভাই আল-আমিন মুনশি বাবার সঙ্গে খাবার হোটেলে কাজ করতেন। দুই ভাই আর বাবার রোজগারে ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। স্থানীয় এক দালালের প্রলোভনে পড়ে ৩০ লাখ টাকা চুক্তিতে দুই ভাইয়ের ইউরোপের দেশ ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গত ৪ মার্চ দালালের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান। এরপর দুবাই থেকে যান লিবিয়ায়। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরে তাঁদের একটি কক্ষে বন্দি করে রাখেন বাংলাদেশি দালালরা।১৫ দিনের মধ্যে দালাল চক্রটি তাঁদের ইতালি পৌঁছানোর আশ্বাস দিয়ে চুক্তির সব টাকা কৌশলে আদায় করে নেয়।
মিলন মুনশি ও আল-আমিনের স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল লিবিয়ার উপকূল থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মিলন, আল-আমিনমহ ৭০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছাকাছি আসার পর ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হয়ে নৌকাটি সাগরে ডুবে যায়। এ সময় কয়েকজন সাঁতরে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও নিখোঁজ থাকেন মিলন, আল–আমিনসহ কয়েকজন বাংলাদেশি। নিখোঁজ থাকলেও দালালদের পক্ষ থেকে স্বজনদের জানানো হয়, তাঁরা জীবিত আছেন। তবে মুঠোফোনে কথা বলার জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও দালালরা নানা কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে ইতালিতে থাকা তাঁদের স্বজন মো. ইসরাফিলের মাধ্যমে মিলন মুনশি ও আল-আমিন মুনশির মারা যাওয়ার কথা তাঁর মা–বাবা জানতে পারেন।
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় চার কিলোমিটার ভেতরে পুয়ালী গ্রাম। এই গ্রামের একটি জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরে দুই ছেলের বউ, দুই নাতি ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন সিরাজ মুনশি।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, সিরাজ মুনশির বাড়িতে স্বজন ও এলাকাবাসী ভিড় করছেন। সিরাজ মুনশির স্ত্রী মায়া বেগমসহ কয়েকজন নারী আহাজারি করছেন। এক পাশে মিলন মুনশির স্ত্রী ফাতেমা বেগম কান্নাকাটি করছেন। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
মিলন মুনশির বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘চার মাস আগে আমার স্বামীর সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা হইছিল। সে তখন কষ্টে কথাগুলো কইছিল। বলেছিল, “দালালরা ভাত খাইতে দেয় না, শুকনা খাবার দেয়।” এর পর থেকে স্বামীর আর খোঁজ পাই নাই। আমার একটামাত্র ছেলে। ও এখনো বোঝে না ওর বাবা আর নাই।’
দুই ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত বাবা সিরাজ মুনশি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরহাদ চেয়ারম্যানের কথায় আমার দুই ছেলেকে তার হাতে অনেক আশা নিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখি ট্যাকাও গেল, আমার দুই ছেলেও গেল। আমার আর কিচ্ছুই রইল না। মাসের পর মাস ছেলে দুইডার খোঁজ পাচ্ছিলাম না। ওগের লগে কথা বলার জন্য চেয়ারম্যানের ধারে বারবার গেছি। খালি ধানাইপানাই করত। এখন ফোন দিলে ধরে না। ধারদেনা কীভাবে শোধ দেব? আমি তো পথে বসে গেলাম!’
মানব পাচার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও খোদ ডাসার উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ফরহাদ মাতুব্বর নিজেই এ দালাল চক্রে প্রধান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানব পাচার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও খোদ ডাসার উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ফরহাদ মাতুব্বর নিজেই এ দালাল চক্রে প্রধান। মিলন ও আল–আমিন ওই ইউপি চেয়ারম্যানের প্রলোভনে ৩০ লাখ টাকায় ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেন। পরে লিবিয়াতে পৌঁছানোর পরে সব টাকা আদায় করা হয়। এর আগেও অভিযুক্ত ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ ওঠে। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলাও হয়। এ ছাড়া দুই বছর আগে ইতালি পাঠানোর কথা বলে কয়েক যুবকের কাছ থেকে ওই চেয়ারম্যান এক হাজার টাকার কয়েকটি বান্ডিল গুনে নিচ্ছেন—এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ইতালি পাঠানোর নামে মিলন ও আল–আমিনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে মো. ফরহাদ মাতুব্বরের মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এলাকার লোকজন এমনিই আমার বিরুদ্ধে কথা বলে। এতে আমার কিছুই হবে না।’
মানব পাচারের ব্যবসা কেন করছেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা আমার বিরুদ্ধে আগে–পরে মানব পাচার আইনে মামলা করেছে, তারাই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমার কোর্টেও যাওয়া লাগে নাই। আর আমি যে মানব পাচার করি, তার কি কোনো প্রমাণ আছে? যারা বলে তারা ভুয়া কথা বলে। এসব নিয়ে আমার কোনো প্যারা নাই, টেনশন নাই। যে যার মতো মন চায় বলতে থাক।’
খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল মারা যাওয়া মিলন ও আল–আমিনের বাড়ি পরিদর্শন করেছে। ভুক্তভোগী পরিবারটিকে আইনি সব সহযোগিতা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাসার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল মারা যাওয়া মিলন ও আল–আমিনের বাড়ি পরিদর্শন করেছে। ভুক্তভোগী পরিবারটিকে আইনি সব সহযোগিতা দেওয়া হবে। তাদের থানায় অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। তারা অভিযোগ দিলেই মামলা নেওয়া হবে।’
ওসি আরও বলেন, ‘অভিযুক্ত ওই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এর আগেও মানব পাচারের অভিযোগ ছিল। তিনি বেশ প্রভাবশালী। তাঁর তিন ছেলে ইতালি থাকেন। এই পথে তাঁর বড় চ্যানেল রয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তাঁর বিরুদ্ধে সব ধরনের তথ্য–প্রমাণ সংগ্রহের জন্য পুলিশ কাজ করছে।’