‘বাঘের থাবার দাগ’ সময়ের স্মারক হয়ে আছে যে মসজিদের দেয়ালে

৫০০ বছরের পুরোনো গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ। গত বুধবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গয়ঘরেছবি: প্রথম আলো

জায়গাটিতে তখন এত মানুষের বসতি ছিল না। ঝোপজঙ্গলে স্থানটি দুর্গম ছিল, অন্য রকম ছিল। বাঘসহ অন্য সব বন্য প্রাণীর বিচরণ ছিল এই স্থানে। এটা অনুমান করা যায় পাঁচ শতাধিক বছর আগের তৈরি মসজিদের দেয়ালের একটি চিহ্ন থেকে। স্থানীয় লোকজন বিশ্বাস করেন, ওই চিহ্ন ‘বাঘের পায়ের থাবার’। সেই দাগ এখনো দেয়ালটিতে সময়ের স্মারক হয়ে আছে। মসজিদটিতে সময়ে সময়ে নানা রকম সংস্কার ও উন্নয়নকাজ হয়েছে। তবে পুরোনো আদল, ‘বাঘের থাবার চিহ্ন’, ফুলের নকশা এখনো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

মসজিদটির নাম ‘গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ’। অবস্থান মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নে। প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে এখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় টিকে আছে। শুধু স্থানীয় মানুষই নয়, আশপাশের এলাকাসহ দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন মসজিদটি দেখতে, নামাজ পড়তে। মসজিদকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনিরও কমতি নেই।

গত বুধবার (২৬ মার্চ) বিকেলে মসজিদটিতে গিয়ে দেখা গেছে, তখন সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আজান পড়তেই চারদিক থেকে মুসল্লিরা নামাজ পড়তে ছুটে এসেছেন। স্থানীয় লোকজন জানালেন, পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের সময় এ রকমই হয়ে থাকে। তবে শুক্রবারে জুমার নামাজে প্রচুর মুসল্লির সমাগম ঘটে। ঐতিহাসিক মসজিদে নামাজে শামিল হতে অনেক দূরের মানুষ এখানে ছুটে আসেন। তখন অনেক সময় মুসল্লিদের স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মসজিদের পুরোনো ভবন অক্ষুণ্ন রেখে মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকে জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দক্ষিণ পাশেও অস্থায়ীভাবে শামিয়ানা টাঙিয়ে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মসজিদের ভেতরের পূর্ব দিকের দেয়ালের থামে এই দাগটি বাঘের থাবার বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত বুধবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গয়ঘরে
ছবি: প্রথম আলো

গয়ঘর গ্রামে টিলামতো স্থানে মসজিদটির অবস্থান। বিভিন্ন সময়ে মসজিদটিতে প্রয়োজনে নানা রকম সংস্কার ও উন্নয়নকাজ হয়েছে। মসজিদের মেঝে ও গম্বুজে টাইলস লাগানো হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর দিকে তিনটি বড় দরজা এবং দুটি করে ছয়টি ছোট দরজা রয়েছে। মসজিদের ভেতরের পূর্ব দিকের দেয়ালের থামে এখনো ‘বাঘের পায়ের থাবার’ তিনটি দাগ আছে। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, মসজিদটি নির্মাণের সময় এখানে বাঘ বিচরণ করত। কোনো বাঘ হয়তো কোনো কারণে কাঁচা দেয়ালে পায়ের থাবা বসিয়েছিল। কয়েক শ বছর ধরে সেই থাবার দাগ এখনো টিকে আছে। এ ছাড়া মসজিদের ভেতরে দেয়ালের ওপরের দিকে আরবি লেখা এবং ফুল-লতার রঙিন নকশা আঁকা আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালের সঙ্গে সাঁটা একটি শিলালিপি রয়েছে। শিলালিপিটি যাতে চুরি না হয়, এ জন্য লোহার খাঁচার বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। মসজিদটির দেয়ালের ইটের গাঁথুনি অনেক পুরু। মসজিদটির মূল আয়তন দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ২৪ হাত করে। গম্বুজের উচ্চতা ১৮ ফুট।

৮৮১ হিজরিতে (১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদ নির্মাণ করা হয় বলে লেখা রয়েছে ফলকে। গত বুধবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গয়ঘরে
ছবি: প্রথম আলো

লেখক-গবেষক সৈয়দ মুর্তাজা আলীর ‘হজরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘সিলেট জেলার আরবি ফারসি শিলালিপি’ অধ্যায়ে লেখা আছে ‘মৌলভীবাজার শহরের তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে গয়ঘর মৌজায় খোজার মসজিদ নামে একটি মসজিদ আছে। উক্ত মসজিদের শিলালিপির অনুবাদ এই, ‘আল্লাহতালা ও রসুল বলেছেন, যে দুনিয়াতে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহতালা বেহেশতে তার জন্যে সত্তরটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন।’

বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, এই মসজিদ নির্মাণ করা হয় সুলতান মাহমুদ শাহর পৌত্র সুলতান বরবক শাহর পুত্র সুলতান শামস উদ্দীন ইউছুফ শাহর আমলে। হাজি আমীরের পৌত্র ও মুসার পুত্র বিখ্যাত মন্ত্রী মজলিস আলম ৮৮১ হিজরিতে (১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদ নির্মাণ করান। সিলেটের শাহজালালের মসজিদে পাওয়া শিলালিপিতে উল্লেখিত ও খোজার মসজিদের শিলালিপিতে উল্লেখিত মজলিস আলম একই ব্যক্তি। একই নামের উভয় নির্মাতাই মন্ত্রী ছিলেন এবং মসজিদ দুটি নির্মিত হয়েছিল চার বছরের ব্যবধানে।

মসজিদটির নামকরণ নিয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। কারও কারও ধারণা, পাঠান বীর খাজা উসমান মান সিংহ কর্তৃক উড়িষ্যা (বর্তমান ওডিশা) থেকে বিতাড়িত হয়ে আসার পথে এই মসজিদে অবস্থান করেছিলেন। সেই থেকে খাজা নামটি পাল্টে গিয়ে খোজা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে আজম শাহ নামের এক কামেল পীর এই মসজিদে আসেন। তাঁর একজন গুরুভাই (একই পীরের মুরিদান বা ভক্ত) হাছন আলীকে মসজিদটিতে রেখে যান। ১৯৪০ সালের দিকে গম্বুজ ভেঙে পড়ে। তখন ওই পীর (আজম শাহ) মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে টাকা সংগ্রহ করেন এবং হবিগঞ্জের বানিয়াচং থেকে ইসমাইল মিস্ত্রি নামে তাঁর পরিচিত একজনকে নিয়ে এসে মসজিদের সংস্কারকাজ করান। ১৯৬০ সালে আরও একবার এই ইসমাইল মিস্ত্রিকে দিয়ে আজম শাহ মসজিদটির সংস্কার করিয়েছেন। সংস্কারের পর আজম শাহ চলে গেলে মসজিদটি আবারও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ঝোপজঙ্গলে স্থানটি ছেয়ে যায়। মসজিদের গম্বুজে বটের চারা, লতাপাতা গজিয়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালের পর থেকে মসজিদটির পরিবর্তন শুরু হয়। নামাজের সময় মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় মসজিদের পূর্ব দিকে এক কক্ষের জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়।

খোজার মসজিদের শিলালিপি
ছবি: প্রথম আলো

প্রাচীন স্থাপত্যকলার নিদর্শন রূপে এই মসজিদকে যেভাবে সংরক্ষণ এবং স্থাপত্যকলার রীতিনীতি মেনে সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ দরকার, সে রকম হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। এতে এরই মাঝে মসজিদটির পুরোনো সৌন্দর্যের অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে।

গয়ঘর গ্রামের মানিক মিয়া জানিয়েছেন, মসজিদে মানুষের জায়গা হয় না। এ কারণে মসজিদটির পুরোনো ভবন ঠিক রেখে দুই দিকে জায়গা বাড়ানো হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ দিকে একটি বড় দিঘি ছিল। এখন ছোট পুকুরের মতো আছে, বাকি অংশ ভরাট হয়ে গেছে।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, মসজিদের বাইরে দুটি বড় কৃষ্ণপাথর (অথবা কষ্টিপাথর) ছিল। লোকমুখে প্রচার আছে, এ পাথর দুটি রাতের অন্ধকারে মসজিদ প্রাঙ্গণে ঘোরাফেরা করত। মানুষ পাথর দুটিকে জীবন্ত মনে করতেন। এই পাথর মুছে অনেকে বুকে-মুখে লাগাতেন। পাথর ধোয়া পানি খেতেন। প্রচলিত আছে, পাথরের ওজন নিয়ে তাচ্ছিল্য করলে সেই পাথর কেউ তুলতে পারতেন না। পাথর অনেক ভারী হয়ে যেত। এই পাথরগুলো এখন নেই। একটি পাথর ‘মারা গেলে’ দক্ষিণ পাশের দিঘিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অপরটি ১৯৯০ সালের দিকে চুরি হয়ে গেছে। অনেকে খোজার মসজিদকে গায়েবি মসজিদ বলে থাকেন। সব ধর্মের মানুষ গাছের নারকেল, পেঁপে, পোষা মোরগসহ নানা মানস, শিরনি নিয়ে মসজিদে আসেন। টাকা দান করেন।

গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদের মোতোয়ালি জহুর মিয়া বুধবার আসরের নামাজ শেষে মসজিদেই অবস্থান করছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত এবং জুমার নামাজ হয়ে থাকে। শুক্রবার ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ আসেন। অনেক দূর থেকেও এই মসজিদে মানুষ নামাজ পড়তে আসেন। মসজিদ দেখতেও অনেকে আসেন।