বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। এখানে সকালে সমুদ্রের লোনাজলে নেমে গোসল, বিকেলে বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ হলেও ইদানীং অনেকে নির্জন সৈকত বেছে নিচ্ছেন। এ জন্য দল বেঁধে পর্যটকেরা ছুটছেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন পয়েন্টের সৈকতে। কোলাহলমুক্ত-নিরিবিলি পরিবেশে পর্যটকেরা সৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি পশ্চিমাকাশে অস্তে চলা সূর্য দেখার সুযোগ নিচ্ছেন।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, গত বৃহস্পতি থেকে রোববার এই চার দিনে সৈকতে ভ্রমণে এসেছেন অন্তত চার লাখ পর্যটক। ৭০ শতাংশ পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল শহরের সুগন্ধা পয়েন্টের দক্ষিণ দিকে কলাতলী এবং উত্তর দিকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত চার কিলোমিটার সৈকতে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ পর্যটক লোকসমাগম এড়াতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের দিকে ছুটছেন। এই সড়কের পশ্চিম পাশে দরিয়ানগর, হিমছড়ি, প্যাঁচারদ্বীপ, ইনানী, পাটোয়ারটেক, মোহাম্মদ শফির বিল, মনখালী, শাপলাপুর, টেকনাফ, সাবরাং পয়েন্টের নির্জন সৈকতে পর্যটকের সমাগম ঘটছে। পর্যটকেরা এসব নির্জন সৈকতে সময় কাটানো পছন্দ করছেন। তবে এসব সৈকতে গোসলের ব্যবস্থা নেই। নিরাপত্তার জন্য মেরিন ড্রাইভে ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল থাকলেও সৈকতের পয়েন্টগুলোতে লাইফগার্ড কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চৌকি নেই।
গতকাল রোববার বিকেলে মেরিন ড্রাইভের নির্জন প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে দেখা গেছে, কয়েক শ পর্যটক বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছেন। এই সৈকতে যেতে মেরিন ড্রাইভ থেকে নেমে একটি কাঠের সাঁকো পেরোতে হয়। কারণ, জোয়ারের সময় বালুচর ডুবে যায়। সাঁকো পেরিয়ে ঝাউবাগানের ভেতর দিয়ে নামতে হয় নির্জন সৈকতে। এই সৈকতে প্যারাসেইলিংয়ে চড়ে আকাশে ওড়ার সুযোগও আছে।
প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে হাঁটুপানিতে নেমে সূর্যের ছবি তুলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী উম্মে হাফসা। সঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও পাঁচজন সহপাঠী রয়েছেন। উম্মে হাফসা প্রথম আলোকে বলেন, দুই দিন আগে ঢাকা থেকে তাঁরা কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন। আগের দিন শনিবার বিকেলে সুগন্ধা পয়েন্টে নেমে দেখেন লাখো মানুষের ভিড়, সেখানে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। তাই সবাই মিলে নির্জন সৈকতে ছুটে আসা।
দলের আরেক সদস্য তামান্না তুষি বলেন, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভটা দারুণ, নজরকাড়া। মেরিন ড্রাইভের পূর্ব পাশে পাহাড়সারি, পশ্চিম পাশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন দৃশ্যের মেরিন ড্রাইভ আছে কি না জানা নেই। তবে নির্জন সৈকতে পর্যটকেরা, বিশেষ করে মেয়েরা বিপদে পড়লে উদ্ধার কিংবা নিরাপত্তার কিছুই নেই।
মেরিন ড্রাইভের পশ্চিম পাশের দরিয়ানগর, হিমছড়ি, পাটোয়ারটেক, শাপলাপুর ও সাবরাং পয়েন্টেও পর্যটকের সমাগম দেখা গেছে। সাবরাং পয়েন্টে সৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি পর্যটকেরা রঙিন ডিঙি নৌকার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ বালুচরে সৃজিত ঝাউবাগানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। নির্জন সৈকতে লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ সবার পছন্দ। পর্যটকদের অনেকে লাল কাঁকড়া ধরতে প্রতিযোগিতায় নামেন। বালুচরে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার গর্ত। মুহূর্তে কাঁকড়া গর্তে ঢুকে পড়ে। তবে লাল কাঁকড়ার যম হচ্ছে পর্যটকবাহী মোটরযান ‘বিচ বাইক’।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, নির্জন সৈকতে পর্যটকের সমাগম বাড়তে থাকায় লাল কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকায় সৈকতে কুকুরের উপদ্রব বাড়ছে। কুকুরের আক্রমণে গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা মা-কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সরওয়ার আলম বলেন, দরিয়ানগর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সৈকতে বন বিভাগ ৫৬৮ হেক্টর বালিয়াড়িতে ১০ লাখ ঝাউগাছ লাগিয়েছে। প্যাঁচারদ্বীপসহ বিভিন্ন পয়েন্টের নির্জন সৈকতে পর্যটকের সমাগম ঘটতে থাকায় ঝাউগাছ ঝুঁকিতে পড়ছে। বনকর্মীরা পর্যটকদের সৈকতে নামতে বাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন। সেখানে পাহারা বসানো হয়েছে। কিন্তু নির্জন সৈকতে পর্যটকবাহী বিচ বাইকের চলাচল বাড়লে একটা লাল কাঁকড়াও রক্ষা করা যাবে না। আজ সোমবার দুপুরে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে নেমে দেখা গেছে, এক কিলোমিটার সৈকতে অন্তত ৪০ হাজার পর্যটকের সমাগম। অধিকাংশ পর্যটক লোনাজলে নেমে গোসল করছেন। কেউ টিউবে গা ভাসিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে খেলছেন, কেউ দ্রুতগতির নৌযান জেটস্কি নিয়ে গভীর জলরাশি ঘুরে আসছেন। কেউ আবার বালুচরে ঘোড়ার পিঠে উঠে কিংবা বিচ বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদিক-সেদিক।
সুগন্ধার উত্তর দিকে সিগাল, লাবণী ও শৈবাল পয়েন্টের দুই কিলোমিটারে আরও ৩০ হাজার এবং দক্ষিণে কলাতলী পর্যন্ত এক কিলোমিটারেও আরও ২৫ হাজারের মতো পর্যটকের সমাগম হয়েছে। সব মিলিয়ে সৈকতের কলাতলী থেকে শৈবাল পয়েন্ট পর্যন্ত চার কিলোমিটারে সমবেত হয়েছেন অন্তত এক লাখ পর্যটক। যা আগের দিন রোববার বিকেলে ছিল দুই লাখের বেশি।
দুপুরে কলাতলী সৈকতে কথা হয় কুমিল্লার দেবীদারের ব্যবসায়ী গিয়াসুল আজমের সঙ্গে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়ে। গিয়াসুল বলেন, কক্সবাজারে সবকিছুর দাম বেশি। আগে যে হোটেলকক্ষ ভাড়া এক হাজার থেকে দুই হাজারের মধ্যে ছিল, তা এখন তিন থেকে চার হাজার টাকা। যে খাবারের দাম ৩৫০ টাকা ছিল, এখন ৫৫০-৬০০ টাকা। রিকশা কিংবা ইজিবাইকে উঠে নেমে গেলেই গুনতে হয় ২০ টাকা। মেরিন ড্রাইভে ঘুরতে গেলে প্রাইভেট কার, খোলা জিপ কিংবা অটোরিকশার ভাড়া গুনতে হয় দুই হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা। এসব দেখার কেউ নেই।
অতিরিক্ত টাকা আদায় বন্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নেমেছেন জানিয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও হোটেলকে জরিমানা করেছেন। কয়েকটিকে সতর্ক করা হয়েছে।
আবু সুফিয়ান বলেন, প্রতিটি হোটেলে কক্ষভাড়ার তালিকা টাঙানো আছে। তালিকা দেখেই পর্যটকেরা কক্ষভাড়া পরিশোধ করছেন। তারপরও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কলাতলীর হাঙর ভাস্কর্য মোড়ে ‘তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্র’ খোলা হয়েছে। অতিরিক্ত কক্ষভাড়া কিংবা রেস্তোরাঁতে খাবারের দাম বেশি আদায় করলে সেখানে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন।