ময়মনসিংহে তুচ্ছ বিরোধে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড 

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত জেলার ১৪টি থানা এলাকায় ৪৮টি হত্যা মামলা হয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার ১০১ জন।

ময়মনসিংহ জেলার ম্যাপ

ময়মনসিংহ জেলায় একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বাবার হাতে সন্তান হত্যা, টুকরা করে ভাতিজাকে হত্যা, ধর্ষণ শেষে মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার মতো আলোচিত ঘটনাও রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত জেলায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৪৮টি মামলা হয়েছে। গত জুনে ঘটেছে আটটি হত্যাকাণ্ড। এসব ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বেশির ভাগ তুচ্ছ বিষয় ও পারিবারিক অন্তঃকলহের কারণেই ঘটেছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত জেলার ১৪টি থানা এলাকায় ৪৮টি হত্যা মামলা হয়। এসব মামলায় ১০১ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে গত এপ্রিল মাসে ১৯টি হত্যা এবং মে মাসে ১০টি হত্যা মামলা হয়। এর আগে ২০২৩ সালে ৮০টি, ২০২২ সালে ১০৯টি এবং ২০২১ সালে ৮১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সবশেষ জুন মাসে জেলায় হত্যার ঘটনা ঘটেছে আটটি।

আনন্দ মোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জরিনা মজুমদার মনে করেন, পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দিন দিন দুর্বল হয়ে যাওয়া; স্বার্থপরতা; পারিবারিক শাসন না থাকায় ঘটনাগুলো ঘটছে। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অপরাধকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে অনেকে উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে অপরাধের দিকে। ধর্মীয় অনুভূতি সঠিকভাবে কাজ করলে এসব অপরাধ কমে যাবে।

জুন মাসে আট হত্যাকাণ্ড

চলতি বছরের জুন মাসে আটটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রয়েছে। এর মধ্যে গত ২ জুন ময়মনসিংহ-মুক্তাগাছা সড়কের মনতলা সেতুর নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ওমর ফারুক ওরফে সৌরভের মরদেহ। চাচাতো বোনকে বিয়ে করায় চাচা ইলিয়াস উদ্দিন নিজের ভাতিজাকে বাসায় ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে মাথা ও দুই পা বিচ্ছিন্ন করে লাগেজে ভরে লাশ গুম করেন। ওমর ফারুকের পরিচয় যেন শনাক্ত না করতে পারে, সে জন্য হাতের আঙুলের মাংস কেটে নেওয়া হয়। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ অভিযুক্ত চাচা, হত্যায় সহযোগী ইলিয়াসের শ্যালক আসাদুজ্জামানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

৩ জুন ফুলপুরের দর্জি পয়ারি দ্বিতীয় খণ্ড গ্রামে বোনকে জমি দেওয়া নিয়ে বিরোধে ভগ্নিপতি আলী হোসেনকে হত্যা করেন শ্যালকেরা। ময়মনসিংহ সদরের পাড়াইল এলাকায় জমি নিয়ে বিরোধে ৪ জুন মধ্যরাতে মৎস্য ব্যবসায়ী রমজান আলীকে পিটিয়ে হত্যা করেন তাঁরই আপন চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা। ৭ জুন ধোবাউড়া উপজেলায় মাত্র দেড় ফুট জমি নিয়ে বিরোধে খুরশেদ মিয়া নামের এক কৃষককে কুপিয়ে হত্যা করেন প্রতিবেশীরা। ৪ জুন গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের তাতীরপয়ার গ্রামের আবদুল বারেক ওরফে হাদিসকে ভাতিজারা মুখে টর্চের আলো ধরা নিয়ে বিরোধে কুপিয়ে জখম করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুন ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।

১৪ জুন সদর উপজেলার চরনিলক্ষীয়া সাথিয়াপাড়া এলাকার একটি পুকুরপাড় থেকে মাটিচাপা দেওয়া নিখোঁজ মানসিক ভারসাম্যহীন রাজিয়া আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১২ জুন রাতে ধর্ষণ শেষে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া হয় রাজিয়াকে। ১৬ জুন বিকেলে সদর উপজেলা চুরখাই এলাকার একটি বাসা থেকে মিনারা আক্তার নামের এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৯ জুন নান্দাইলে বীজতলার আল বাঁধা নিয়ে চাচাতো ভাইয়ের হাতে খুন হন লাল মিয়া নামের এক যুবক। নান্দাইলে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে চাচাতো ভাইদের হাতে আহত হয়ে ২৩ জুন মারা যান লাল মিয়া। ৩০ জুন রাতে ত্রিশাল উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের চাওলাদি গ্রামে জমির আল নিয়ে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে বিরোধে হামলায় গুরুতর আহত হন বোরহান উদ্দিন ওরফে ভুট্টু মিয়া এবং তাঁর ভাগনে মিলন মিয়া। ১ জুলাই দুপুরে মিলন মিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজে এবং রাত ১টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে মারা যান বোরহান।

গত মে মাসের মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ত্রিশাল উপজেলায়। ২১ মে উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কাকচর নয়াপাড়া গ্রাম থেকে মাটিচাপা দেওয়া মা ও দুই সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মায়ের দেহ গর্তে থাকলেও দুই শিশুসন্তানের দেহ শিয়াল–কুকুরে টেনে বের করে ছিন্নভিন্ন করে। পুলিশি তদন্তে উঠে আসে, কাকচর নয়াপাড়া গ্রামের আলী হোসেন অভাবের কারণে এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী আমেনা খাতুন (২৫) এবং দুই ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (৪) ও ছোট ছেলে আনাছকে (৩০ মাস) হত্যা করে মাটিচাপা দেন।

ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে মানুষের সামাজিক বন্ধন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা দিন দিন কমছে। ঘটনাগুলোর পর তাৎক্ষণিক অপরাধীদের ধরে শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’