সঠিকভাবে স্যালাইন না খাওয়ানোয় শিশু রাফসানের জীবন ঝুঁকিতে

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রাফসানকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল শনিবার তোলাছবি: প্রথম আলো

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু রাফসানকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ৯ মাসের শিশুটির কিডনি কার্যকারিতা হারিয়েছে; সারা শরীর ফুলে গেছে। হাসপাতালের বিছানায় ধুঁকছে সে।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রাফসানকে সঠিক নিয়মে স্যালাইন খাওয়ানো হয়নি। অল্প পরিমাণ পানিতে এক প্যাকেট স্যালাইন গুলে শিশুটিকে খাওয়ানো হয়েছে। তার শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গেছে; কিডনি ফেইল করেছে (কার্যকারিতা হারিয়েছে)।

রাফসান ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চকরাধাকানাই গ্রামের শাহীন ইসলামের ছেলে। শাহীন গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। স্ত্রী রুবি আক্তার ও দুই সন্তানকে নিয়ে মৌচাক এলাকায় থাকেন তিনি।

গত ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাফসানকে ভর্তি করা হয়। শনিবার সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, শিশু রাফসানের চোখ বন্ধ। তার হাতে ক্যানুলা; চলছে স্যালাইন। তার চোখ, মুখ ফোলা।

শিশু বিভাগে হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার মাজহারুল আমিন বলেন, খাবার স্যালাইন হচ্ছে লবণের দ্রবণ। আধা লিটার পানির সঙ্গে এক প্যাকেট স্যালাইন গুলাতে হয়। কিন্তু অনেক অসচেতন অভিভাবক সঠিকভাবে স্যালাইন খাওয়ান না। এতে শিশুদের শরীরে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। বাচ্চার শরীরে লবণের তারতম্য হলে চিকিৎসা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সঠিকভাবে স্যালাইন না খাওয়ানোর ফলে বাচ্চাদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ে, জীবন পর্যন্ত চলে যেতে পারে। সচেতনতার অভাবে এমনটি হচ্ছে।

রাফসানের পাশে তার মা রুবি আক্তার উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন। তিনি বললেন, ‘ছেলে অসুস্থ হওয়ার পর ১২ দিন গাজীপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছিল। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। ভুল করে স্যালাইন খাওয়ানোর ফলে কিডনিতে সমস্যা হবে, তা জানতাম না। আগে জানলে সন্তানের এত বড় ক্ষতি হতো না। সন্তানের এই অবস্থা দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, খুব কষ্ট হয়।’

আরও পড়ুন
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩৫০ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছর বয়সের বেশি শিশু ছিল ৩ জন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৩১ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি ইউনিটে প্রতিদিন রোগী ভর্তি করা হয়। শীতের তীব্রতা বাড়ায় ডায়ারিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩৫০ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছর বয়সের বেশি শিশু ছিল ৩ জন। এই ৭ দিনে শিশু ওয়ার্ডে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত কোনো শিশুর মৃত্যু হয়নি। ভর্তি হওয়া রোগীদের ৯০ শতাংশের বেশি রোটাভাইরাসে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তবে হাসপাতালে রোটাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।

এ সম্পর্কে হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার মাজহারুল আমিন বলেন, ‘আমরা রোগীর লক্ষণ ও ইতিহাস শুনে বুঝতে পারি, সেটা রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়া। এটি পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও ময়মনসিংহে তা নেই। রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় শিশুরা পানিস্বল্পতায় ভোগে। নিয়ম অনুযায়ী খাবার স্যালাইন না দিলে সমস্যা বাড়ে।’

আরও পড়ুন
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগীর চাপ বেড়েছে
ছবি: প্রথম আলো

শিশু বিভাগের তিনটি ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন অভিভাবকেরা। ১৮ মাস বয়সী রহমত উল্লাহকে স্যালাইন খাওয়াচ্ছিলেন নানি রেহেনা বেগম। শিশুটিকে শুক্রবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বাগান এলাকায়। রেহেনা বেগম বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে রহমতের ডায়রিয়া শুরু হয়। কিছু খেতে চায় না; বারবার পাতলা পায়খানা করছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জামশেদ আলম বলেন, ‘তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা ধরে নিতে পারি, শীতকালে শিশুদের ডায়রিয়ার ৯০ শতাংশ রোটাভাইরাসজনিত। এটির স্থায়ীত্ব পাঁচ-সাত দিন হতে পারে বা তারও কম হতে পারে। ডায়রিয়ার শুরুতে শিশুদের সঠিক নিয়ম মেনে স্যালাইন খাওয়ানো প্রয়োজন। কারণ, আমরা এমন কিছু রোগী পাচ্ছি, অতিরিক্ত ঘনত্বের ওআরএস খাওয়ানোর ফলে জটিল পরিস্থিতি হচ্ছে।’

জামশেদ আলম আরও বলেন, ‘রোটাভাইরাস শনাক্তের পদ্ধতি স্থানীয়ভাবে সহজ নয়। আমরা স্যাম্পল (নমুনা) সংগ্রহ করে আইসিসিডিআরবিতে পাঠাই। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে ডায়রিয়ার যে চিকিৎসা পদ্ধতি, তা ব্যবহার করে চিকিৎসা চলমান থাকে।’