হাজারো মানুষকে হাসির জোয়ারে ভাসিয়ে একা একা কাঁদেন তাঁরা
গোলাকার সার্কাস মঞ্চের দর্শকসারিতে অপেক্ষা করছেন হাজারের বেশি মানুষ। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন রাত ৯টা। দিনভর খরতাপের পর ভ্যাপসা গরমে বদ্ধ ছাউনির ভেতর অনেকটা হাঁসফাঁস অবস্থা। তবু দর্শকদের দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। কখন শুরু হবে সার্কাসের শো, কখনই–বা দেখবেন খেলা!
মিনিট দশেক পর সাউন্ডবক্সে উচ্চশব্দে বেজে উঠল গান। গরমের অস্বস্তির মধ্যেও গানের তালে যেন কিছুটা উজ্জীবিত হলেন দর্শক। এর মধ্যেই ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমারÑ‘জিনা ইঁহা, মারনা ইঁহা, ইসকে সিবা জানা কাঁহা’ গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে মঞ্চে এলেন খর্বাকৃতির তিন ব্যক্তি। পরনের ঢোলা প্যান্ট, ফোলা জামা আর নাক-মুখে লাল, হলুদ, সাদা রং বলে দিচ্ছে তাঁরা ‘জোকার’। তাঁদের নাচ, গান আর কৌতুকাভিনয় আকৃষ্ট করল সব দর্শকের দৃষ্টি। এরপর তাঁদের হাস্যরসাত্মক কর্মকাণ্ডে হাসির জোয়ার বইল পুরোটা সময়।
গত মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) গাজীপুরের রথমেলায় আয়োজিত ‘রউশন সার্কাস শো’তে দেখা যায় এই চিত্র। মানুষ হাসানোর এমন কর্মকাণ্ড দেখে আলাপের আগ্রহ হলো। খেলার খানিক বিরতিতে কথা বলার জন্য সাজঘরে যেতেই প্রচণ্ড ব্যস্ততার কথা জানালেন তাঁরা। একজনের ভাষ্য, ‘এহন কথা বলার কোনো অবস্থা নাই। কোনো কারণে শো না জমলে, মানুষ মজা না পাইলে আমাগোর দুর্নাম হইবো। পরে আমাগোরে কাজে নিবো না। তহন না খাইয়্যা থাহন লাগবো। আপনে দয়া কইর্যা পরে আসেন।’
দর্শকসারিতে ফিরে গিয়ে আবারও অপেক্ষা। খেলা চলছে। এর ফাঁকে ফাঁকে সেই তিন জোকারের অভিনয় দেখে হাসিতে বুঁদ মানুষ। শো শেষ হতে হতে রাত সাড়ে ১১টা। ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে লাগল পুরো সার্কাসস্থল। এবার নিরিবিলি পরিবেশে তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়। কথায় কথায় জানা গেল, তাঁদের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক কান্নার গল্প। যে গল্পে আছে পারিবারিক অভাব-অনটন, জীবিকার তাগিদ আর অবহেলাসহ নানা কষ্টের কথা।
এভাবে রাস্তায় রাস্তায় খেলা দেখানো আর ভাল্লাগে না। পরিবার নিয়া টিকা থাকা খুব কষ্ট হইয়্যা যায়। কষ্টে মাঝেমধ্যে একা একা কান্দি।
আবদুর রহিমের (২৭) বাড়ি নওগাঁ জেলায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি মেজ। ছোটবেলায় বাবা শহিদুলের হাত ধরে সার্কাসে যোগ দেন তিনি। এখন শহিদুলের বয়স বেড়েছে। কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই পুরো পরিবার নির্ভর করছে রহিমের ওপর। সার্কাসে মানুষ হাসিয়ে যা পান, তা দিয়েই কোনোরকম চলে সংসার। এর মধ্যে কোনো কারণে শো না হলে পথে বসার অবস্থা তৈরি হয় তাঁর। তখন পেটের দায়ে রাস্তায় বের হতে হয় তাঁর।
রহিমের ভাষায়, ‘যে কদিন শো চলে, মানুষকে হাসাইয়া প্রতিদিন ৬০০–৭০০ কইর্যা টেকা পাই। তা দিয়া কোনোরকম চলন যায়। কিন্তু এহন তো আগের মতো শো–ই হয় না। হেললাইগ্যা বছরের বেশির ভাগ সময়ই রাস্তায় খেলা দেখাই। রোদ-বৃষ্টিতে পুইড়্যা মানুষকে মজা দিই। তাতে কোনোরকম বাঁইচা থাকন যায়।’ রহিম আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমরা খালি নামেই মানুষ। আমাগোর শখ-আহ্লাদ বইল্যা কিচ্ছু নাই। কয়ড্যা টেকার লাইগ্যা জোকারি করি। মানুষ হাসাই। এ ছাড়া আমাগোর আর কোনো উপায় নাই।’
তিনজনের আরেকজনের নামও আবদুর রহিম (৩৫)। বাড়ি বরিশালে। প্রায় ২০ বছর ধরে সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তাঁর পরিবারে দুই ছেলেমেয়ে। সার্কাসে খেলা দেখানোই তাঁর মূল পেশা। বলছিলেন, ‘আমরা খাটো, হেললাইগ্যা আমাগোরে কেউ মূল্যায়ন করে না। একটা কাজের লাইগ্যা বহু জায়গায় ঘুরছি, বহু মানুষরে কইছি, কিন্তু কেউ একটা কাজ দেয় নাই। হেললাইগ্যা পরে বাধ্য হইয়া এই পেশায় নামছি। প্রতি মাসে বউ-বাচ্চার কাছে টাকা পাঠাইতে অয়। কোনো মাসে কাজ না থাকলে শুরু হয় কান্নাকাটি।’
এসব শুনতে শুনতেই আরও বেশি মন খারাপ করে ফেলেন তাঁদের সঙ্গে থাকা মশিউর (৩৪)। কিছুক্ষণ আগেও (সার্কাসমঞ্চে) যাঁর কর্মকাণ্ড দেখে হেসেছে হাজারো মানুষ, সেই তিনিই যেন হারিয়ে গেলেন মন খারাপের রাজ্যে। রহিমদের সঙ্গে কথা বলার সময় একদৃষ্টিতে কোথায় যেন তাকিয়ে ছিলেন তিনি। এরপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সার্কাস দেখতে আইস্যা সবাই খালি আমাগোর হাসিমুখটাই দেখে। শো শেষে হাসতে হাসতে বাড়ি যায়। কিন্তু আমাগোর হাসির আড়ালে যে একটা কষ্টের জীবন আছে, তা কারও চোখে পড়ে না। কেউ বোঝারও চেষ্টা করে না। আমরাও এসব নিয়া দুঃখ করি না। সব কষ্ট নিজের মাজে রাইখ্যা খেলা দেখায় যাই। কী করুম, একভাবে তো বাঁচন লাগবো।’
কথা বলতে বলতে রাত ১২টা পেরিয়ে যায়। সারা দিন খেলা দেখিয়ে ক্লান্ত তিনজনই বিদায় নিতে চান। যাওয়ার আগে আবদুর রহিম (২৭) বলেন, ‘সরকার বা সমাজের পক্ষ থেইক্যাও আমাদের দিকে কোনো নজর নাই। মাস শেষে ২ হাজার ২০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পাই। তা দিয়ে কিছুই অয় না। আমাগোর লাইগ্যা সরকার বা সমাজের পক্ষ থেইক্যা একটা কাজের ব্যবস্থা করলে খুব উপকার পাইতাম। এভাবে রাস্তায় রাস্তায় খেলা দেখানো আর ভাল্লাগে না। পরিবার নিয়া টিকা থাকা খুব কষ্ট হইয়্যা যায়। কষ্টে মাঝেমধ্যে একা একা কান্দি।’