২৫ বছর ধরে মাটির রঙের ফেরিওয়ালা আমিনুল
নিজের মাটির বাড়ি। দেয়াল ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ওপরে জরাজীর্ণ টিনের ছাউনি। বাড়িটিতে কোনো রঙের ছোঁয়া নেই। অথচ বাড়িওয়ালা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মাটির বাড়িতে প্রলেপ দেওয়ার রং বিক্রি করে বেড়ান। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি এই রং বিক্রি করেন।
এই ফেরিওয়ালার নাম আমিনুল ইসলাম। তাঁর বয়স ৫০ বছর। বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার চান্দইল চুনিয়াপাড়া গ্রামে। জীবনের অর্ধেক সময়জুড়ে তিনি রঙের ফেরিওয়ালা।
এই অঞ্চলের জনসংস্কৃতির একটি অংশ হচ্ছে, লাল মাটি দিয়ে মাটির বাড়িতে লেপ দেওয়া ও আলপনা তৈরি করা। এসব বাড়ি যত দিন থাকবে, আমিনুলের এই পেশাও তত দিন থাকবে। কারণ, এই অঞ্চলে মাটির রঙের একমাত্র ফেরিওয়ালা হিসেবে তিনিই টিকে আছেন।
আমিনুলের পড়াশোনা দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা তিনি। বড় ছেলে সোহেল রানা বিয়ে করেছেন। একটি সন্তানও আছে। তাঁর লেখাপড়াও বাবার মতোই। নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। ছোট ছেলে বিএসসি পাস করেছেন। ঢাকার একটি কারখানায় ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। ঢাকায় থাকেন। একমাত্র মেয়ে রানি খাতুন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর বিয়ে হয়েছিল, সংসার টেকেনি। এখন বাবার বাড়িতে থাকেন। বাড়ির ভিটে ছাড়া নিজের কোনো আবাদি জমি নেই আমিনুলের। সংসারে আয়ের অন্য কোনো পথও নেই। তাই ২৫ বছর ধরে তিনি মাটির রং বিক্রি করে বেড়ান।
এই অঞ্চলের মাটি খুঁড়লে একটা পর্যায়ে গিয়ে লাল রঙের একধরনের কাঁকর পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে লোকজন এটাকে ‘আঁকির’ বলে থাকেন। এই আঁকির তুলে এনে খেজুরগুড়ের পাটালির মতো করে চাকতি তৈরি করা হয়। এটা রোদে শুকানো হয়। এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকা দামের চাকতি তৈরি করেন আমিনুল। নিজেই মাটি খুঁড়ে রঙিন মাটির আঁকির বের করেন। তা দিয়েই তৈরি করেন লাল মাটির চাকতি।
সম্প্রতি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের রামনগর মোড়ে আমিনুলের সঙ্গে দেখা হয়। স্থানীয় কামারপাড়া গ্রামের সুজন কর্মকার তাঁর কাছ থেকে রং কিনলেন। সুজন বললেন, তাঁদের মাটির বাড়ি। এই আঁকির লেপা না দিলে পায়ে ধুলা লাগে। লেপলে দেখতেও ভালো লাগে।
পরে আমিনুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির চারদিকে এই চাকতি শুকাতে দেওয়া আছে। তিনি নিজেই এগুলো উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন।
এই দুর্মূল্যের বাজারে আমিনুলের মাটির চাকতির দাম এক, দুই ও পাঁচ টাকা। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তিনি কম দামে মাটির রং বিক্রি করেন। আমিনুল আগে পায়ে চালিত ভ্যানে করে মাটির রঙের চাকি নিয়ে বের হতেন। তিন বছর ধরে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে রং ফেরি করেন। কীভাবে এই ঘোড়ার গাড়ি করলেন, জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, পায়ে ঠেলা ভ্যানে বেশি দূর যাওয়া যেত না, অনেক কষ্ট হতো। একজন একটা রুগ্ণ ঘোড়া বিক্রি করতে চাইলে তিনি কেনার আগ্রহ দেখান। ৪ হাজার টাকায় তিনি ঘোড়াটি কেনেন। এরপর তাঁর যত্নে ঘোড়ার স্বাস্থ্য ভালো হয়। জোড়াতালি দিয়ে ১৪ হাজার টাকা জোগাড় করে গাড়িটা বানান। এর পর থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করেই তিনি তিন জেলার বিভিন্ন গ্রামে যান।
পথে দেখা কামারপাড়ার সুফিয়া বেগমের সঙ্গে। তাঁর হাতেও লাল মাটি। তিনি বললেন, ‘লাল মাটি দিয়া ঘর লেপাপোছা করলে বাড়িঘর দেখতে খুব সুন্দর লাগে। তাই হামি আমিনুল চাচার কাছ থ্যাকা লাল মাটি কিননু।’
নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক সবুজ কুমার সরকারের বাড়ির বাইরের দেয়ালে দেখা যায় এই লাল মাটির আলপনা। সবুজ সরকার বললেন, তাঁর মা বাণী সরকার বরাবরই লাল মাটির রং দিয়ে বাড়ির বাইরের দেয়াল লেপে দেন। এখন তাঁর বয়স হয়েছে। একা পারেন না। কাজের লোক নিয়ে করেন। তবু লাল মাটির রং ছাড়া মায়ের চলে না। তবে দিন দিন গ্রামাঞ্চলে মাটির বাড়ির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে লাল মাটির সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। আর এ অঞ্চলে আমিনুল ইসলামই শুধু এ পেশা ধরে রেখেছেন।
আমিনুলের বাড়ি থেকে আসার পরে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির সময় তাঁর আয়–রোজগার কেমনে চলে, জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃষ্টি হামার মাটির ব্যবসা মাটি কইরে দিচ্ছে। বর্ষাকালে ব্যবসা ঠিকমতো হয় না। ছেলেমেয়েদের মতো ঘোড়াটাকেও খাওয়াতে হয়।’