রোহিঙ্গাদের কাছে রাখাইনে নির্যাতনের কথা শুনলেন উজরা জেয়া
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেছেন। আজ বুধবার বেলা পৌনে ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বালুখালী ও আশপাশের তিনটি আশ্রয়শিবির এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার শরণার্থী সেবা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন তিনি।
আশ্রয়শিবির পরিদর্শনের সময় অন্তত ২৫ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। বৈঠকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাঁদের ওপর চালানো গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বর্ণনা দেন। পাশাপাশি নিরাপদ, টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সকাল ৯টার দিকে উজরা জেয়ার নেতৃত্বে ৯ সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে করে কক্সবাজার বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এরপর সড়কপথে সরাসরি উখিয়ার বালুখালী (ক্যাম্প-৯) আশ্রয়শিবিরে যায়। উজরা জেয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনান্ড লু এবং মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক কর্মকর্তা অঞ্জলী কউর।
সূত্র জানায়, মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বেলা ১১টার দিকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৯) পৌঁছে প্রথমে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের নিবন্ধন সেন্টার পরিদর্শন করেন। সেখানে ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ক্যাম্পের পরিবেশ-পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সেখান থেকে একই আশ্রয়শিবিরের ইউএনএইচসিআরের পুষ্টিকেন্দ্র, ডব্লিউএফপির ইভাউচার আউটলেট, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) রোহিঙ্গা কালচারাল মেমোরি সেন্টার ও ইউএনএফপিএর উইমেন অ্যান্ড গার্লস সেইফ স্পেস সেন্টার পরিদর্শন করেন তাঁরা।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১১) একটি কমিউনিটি সেন্টারে অন্তত ২৫ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে বৈঠক করেন উজরা জেয়া। উপস্থিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১২ জন আশ্রয়শিবিরের ভেতরে গড়ে তোলা বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমাম ও শিক্ষক। এ সময় রোহিঙ্গা নারী ছিলেন সাতজন।
বৈঠক শেষে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, উজরা জেয়া তাঁদের (শিক্ষক ও ইমাম) কাছে জানতে চেয়েছেন, আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা ঠিকমতো ধর্মকর্ম করতে পারছেন কি না? আশ্রয়শিবিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন? জবাবে তাঁরা বলেছেন, আশ্রয়শিবিরে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করা গেলেও নিরাপত্তার অভাব খুবই। প্রায় প্রতিদিন খুনখারাবি, অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলিতে রোহিঙ্গারা মারা যাচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।
আরেকজন রোহিঙ্গা নারী বলেন, বৈঠকে তিনি উজরা জেয়াকে বলেছেন, আশ্রয়শিবিরে দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য কমিয়ে দেওয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। মিয়ানমারে ফেরানোর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যত দিন থাকতে হয়, তত দিন যেন রোহিঙ্গাদের সাহায্য–সহযোগিতা আগের মতো থাকে, সেই সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
বৈঠকে কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বর্বর নির্যাতন, অত্যাচার, গণহত্যা ও নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার যে মামলা চলমান, তা দ্রুত কার্যকর (নিষ্পত্তি) করতে উজরা জেয়ার সহযোগিতা চেয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা। একজন রোহিঙ্গা নেতা আশ্রয়শিবিরে শিশুশিক্ষা কার্যক্রম বাড়ানোর কথা বলেছেন।
জবাবে উজরা জেয়া রোহিঙ্গাদের বলেন, আইসিসির বিচার ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চলমান প্রক্রিয়া। সবকিছু তাঁদের পর্যবেক্ষণে আছে। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা নেতাদের ধৈর্য ধরতে বলেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান।
বৈঠকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) একাংশের চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জুবাইর উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে তিনি উজরা জেয়ার কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেন। বৈঠক শেষে জুবাইর সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে আমরা রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়েছি উজরার কাছে। চিঠিতে আমরা প্রত্যাবাসন দ্রুত কার্যকর করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে সহযোগিতা চেয়েছি। আমরা দ্রুত নিজেদের জন্মভূমিতে (রাখাইন) ফিরতে চাই। কিন্তু সেটা হতে হবে নিরাপত্তার সঙ্গে, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই।’
বেলা আড়াইটার দিকে উজরা জেয়া উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের বাইরে ইউএনএইচসিআর নির্মিত বিশেষায়িত হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। বেলা তিনটার দিকে আশ্রয়শিবির থেকে সড়কপথে কক্সবাজার শহরে ফিরে আসেন তিনি। শহরে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) সঙ্গে বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরার কথা আছে প্রতিনিধিদলের। তবে কক্সবাজার সফর নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি উজরা।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফর ঘিরে আশ্রয়শিবিরে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে ৮ এপিবিএনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এ সতর্কতা। সকাল থেকে আশ্রয়শিবিরের প্রবেশপথ ও ভেতরের সড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়।
চার দিনের সফরে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন উজরা জেয়া।