মাদারীপুর–৩ আসনে ৩৬ দিনে ২৫ নির্বাচনী সংঘাতে হতাহত ৭০
আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ ও বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে।
মাদারীপুর-৩ (কালকিনি–ডাসার–সদর একাংশ) আসনে নির্বাচনের আগে–পরে বাড়িঘর-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অন্তত ২৫টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সংঘাতে দুজনের প্রাণহানিসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৭০ জন। এসব ঘটনায় ১৬টি মামলায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের ৬২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অজ্ঞাতনামা আসামি হাজারের বেশি। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিলেও উভয় পক্ষের অনেকেই এখনো এলাকাছাড়া। আবার সংঘাত এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এখনো অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন আছে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা–কর্মী ও সাধারণ ভোটাররা বলছেন, আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ ও বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের দ্বন্দ্ব নিরসন না হওয়া পর্যন্ত সংঘাত থামবে না। পুলিশের ভাষ্য, নির্বাচনের সময় ঘটনা ঘটলেও সব ঘটনা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নয়। স্থানীয় আধিপত্যের কারণেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত।
আবদুস সোবহান গোলাপ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে প্রথম তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনে আবদুস সোবহানকে ৩৪ হাজার ৬৬২ ভোটে পরাজিত করেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা বেগম।
হামলা–সংঘাতের ঘটনায় সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে একে–অপরকে দোষারোপ করা হলেও উভয় পক্ষই এলাকায় শান্তি চায়। তাদের ভাষ্য, অপর পক্ষের কারণে তারা এলাকায় থাকতে পারছে না।
আবদুস সোবহান গোলাপ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে প্রথম তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনে আবদুস সোবহানকে ৩৪ হাজার ৬৬২ ভোটে পরাজিত করেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা বেগম। তাহমিনা একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর-৩ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর ২১ ডিসেম্বর প্রথম সংঘাতের ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে। স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের মিছিলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ২৩ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী এসকেন্দার খাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ভোটের আগের দিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক নারী পোলিং এজেন্টকে কুপিয়ে জখম করা হয়। অন্যদিকে নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরদার মো. লোকমান হোসেনের বাড়িতে হামলা হয়। ভোটের আগের দিন বিভিন্ন এলাকায় একাধিক সংঘর্ষ ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
‘নির্বাচনের পর নৌকায় ভোট দেওয়ায় অনেকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। আমাদের অনেক লোকজন আহত হয়েছেন। আমাদের লোকজনও এলাকায় থাকতে পারছেন না। তবু আমরা সংঘাত চাই না; শান্তি চাই।’সরদার মো. লোকমান হোসেন, কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ চলাকালে ঘটকচর ও কেন্দুয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুসারীদের ওপর কয়েক দফা হামলা হয়। তখন বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। ভোটের পরদিন নৌকায় ভোট দেওয়ায় কালকিনি পৌরসভার চরঠেঙ্গামার এলাকার বেদেপল্লিতে অন্তত ২০টি বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ৮ জানুয়ারি কালকিনির আলীনগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলা হয়। এতে আহত ১০ জনের মধ্যে এমারত হোসেন নামে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ জানুয়ারি মারা যান। সবশেষ ২৫ জানুয়ারি ঘটকচরে ঈগল ও নৌকার অনুসারীরা ফের সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় তিনটি বসতঘর ও অন্তত ১০টি দোকানে হামলা ও লুটপাট করা হয়।
সংঘাতের সব ঘটনা নির্বাচনকেন্দ্রিক নয় বলে দাবি পুলিশের। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) কামরুল হাসান বলেন, নির্বাচনের সময় অনেক ঘটনাই ঘটেছে। সব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হয়নি। কিছু পারিবারিক, গোষ্ঠীগত ও স্থানীয় আধিপত্যের ঘটনা আছে। নির্বাচন ঘিরে স্থানীয় পক্ষগুলো দুই প্রার্থীর পক্ষে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে। প্রতিটি ঘটনা গুরত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা আছে।
আমি কখনোই সহিংসতার রাজনীতি করিনি। আগামী দিনেও করব না। নির্বাচন করতে গিয়ে আমার দুজন কর্মী খুন হয়েছেন। গোলাপ সাহেব পরাজয় না মেনে নিতে পেরে অনুসারীদের দিয়ে অনেকের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছেন, লুটপাট করেছেন। অনেককে বাড়িছাড়া করেছেন। তবু আমি সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছি। আমি গোলাপ সাহেবকে অনুরোধ করব, এলাকায় আসুন, আপনার অনুসারীদের শান্ত থাকতে বলুন।নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম
পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্র জানায়, ২১ ডিসেম্বর থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৬ দিনে ১৬টি সংঘাতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। সদর মডেল থানায় ৪টি ও কালকিনি থানায় ১২টি। এর মধ্যে ১০টি মামলার বাদী আবদুস সোবহান গোলাপের অনুসারীরা। বাকি ৬টি মামলার বাদী তাহমিনা বেগমের অনুসারীরা। সদরের চারটি মামলার আসামি ১৮৮ জন। অন্যদিকে কালকিনির ১২ মামলায় আসামি ৪৩৬ জন। এসব মামলায় হাজারের বেশি অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, উভয় পক্ষ থানায় মামলা করায় গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর, আলীনগর ও কেন্দুয়া ইউনিয়নের অনেক হাটবাজার এখনো থমথমে। অনেক গ্রাম পুরুষশূন্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উভয় পক্ষের কয়েকজন আসামি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে সরাসরি সংঘাতে না জড়িয়েও তাঁরা আসামি হয়েছেন। এলাকায় গেলে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে এবং প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে তাঁরা আপাতত এলাকার বাইরে থাকছেন।
নির্বাচনের পর নৌকায় ভোট দেওয়ায় অনেকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। আমাদের অনেক লোকজন আহত হয়েছেন। আমাদের লোকজনও এলাকায় থাকতে পারছেন না। তবু আমরা সংঘাত চাই না; শান্তি চাই।কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরদার মো. লোকমান হোসেন
নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ ও বিজয়ী প্রার্থী তাহমিনা বেগম দুজনই সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানালেও এখনো সংঘাত চলছে। নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কখনোই সহিংসতার রাজনীতি করিনি। আগামী দিনেও করব না। নির্বাচন করতে গিয়ে আমার দুজন কর্মী খুন হয়েছেন। গোলাপ সাহেব পরাজয় না মেনে নিতে পেরে অনুসারীদের দিয়ে অনেকের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছেন, লুটপাট করেছেন। অনেককে বাড়িছাড়া করেছেন। তবু আমি সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছি। আমি গোলাপ সাহেবকে অনুরোধ করব, এলাকায় আসুন, আপনার অনুসারীদের শান্ত থাকতে বলুন।’
এ বিষয়ে আবদুস সোবহানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি। তাঁর মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরদার মো. লোকমান হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের পর নৌকায় ভোট দেওয়ায় অনেকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। আমাদের অনেক লোকজন আহত হয়েছেন। আমাদের লোকজনও এলাকায় থাকতে পারছেন না। তবু আমরা সংঘাত চাই না; শান্তি চাই।’