কিশোরগঞ্জে সিঁধ কেটে চুরি হওয়া শিশুটিকে যেভাবে উদ্ধার করল পুলিশ
আড়াই মাস বয়সী শিশু জুনায়েদকে নিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন মা। শেষ রাতে ঘুম থেকে জেগে দেখেন ছেলে তাঁর পাশে নেই। বিছানা থেকে উঠে ছেলেকে খাটের আশপাশে খুঁজতে থাকেন তিনি। কিন্তু কোথাও পাননি।
একপর্যায়ে মা দেখেন কাঁচা বসতঘরটির ভিটির পেছনের দিকে মাটি খোঁড়া অর্থাৎ সিঁধ কাটা। সানজিদার চিৎকার আর কান্নাকাটিতে আত্মীয়স্বজনসহ প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গলসহ সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি শিশু জুনায়েদকে। মসজিদের মাইকেও শিশুটির সন্ধান চেয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর শিশু জুনায়েদকে উদ্ধার করে পুলিশ। আটক করা হয় দুজনকে। ঘটনাটি ঘটেছে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার তালজাঙ্গা ইউনিয়নের শাহবাগ পাঁচপাড়া গ্রামে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহবাগ পাঁচপাড়া গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন ও সানজিদা দম্পতির আড়াই মাস বয়সের শিশুকে ঘরের সিঁধ কেটে গত রোববার শেষ রাতে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। পরে গতকাল সোমবার সকালে খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযানে নামে গোয়েন্দা পুলিশ ও তাড়াইল থানা-পুলিশ। ওই দিন বিকেল চারটার দিকে পুলিশ জানতে পারে, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নীলগঞ্জ বেত্রাহাটি গ্রামের রুবেল মিয়ার বাড়িতে শিশুটি রয়েছে। এরপর সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে শিশুটিকে মায়ের কোলে তুলে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় রুবেল মিয়া (৩২) ও তাঁর শাশুড়ি সত্তু বেগমকে (৫৫) পুলিশ আটক করে।
শিশুটিকে উদ্ধার করতে বেশ কিছু ধাপ অনুসরণ করেছে পুলিশ। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধানের সময় তিন থেকে চারটি বিষয়কে লক্ষ্য করে পুলিশ এগোয়। প্রথমত, এটি হত্যাকাণ্ড কী না, তা নিশ্চিত হতে পুরো এলাকায় খোঁজা হয়। কিন্তু এ ধরনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, হিজড়ারা শিশুটিকে নিয়ে গেছে কি না, সেটিও বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সে রকমও কিছু পাওয়া যায়নি। পরে মনে হয়েছে এটা চুরি। কিন্তু চুরি কে বা কারা করতে পারে, তা বের করতে দুই শ্রেণির লোককে লক্ষ্যে রেখে আগায় পুলিশ, যার অনেকগুলো কন্যাসন্তান আছে, শুধু একটি ছেলের জন্য ভীষণ রকমের প্রত্যাশা, আশপাশের এমন লোকজনকে খোঁজা হয়। এর মধ্যে একটি ‘ক্লু’ পেয়ে সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে পুলিশ।
পুলিশ সুপার বলেন, ক্লু অনুযায়ী পুলিশ জানতে পারে, সদর উপজেলার নীলগঞ্জ বেত্রাহাটি গ্রামের রুবেল-খাদিজা দম্পতির তিনটি কন্যাসন্তান আছে। চতুর্থ সন্তানও কন্যা হবে, এটা তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য রোববার যে হাসপাতালে খাদিজা কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছেন, সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে গিয়ে খাদিজা একটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান হয়েছে জানা যায়। দম্পতির দাবি অনুযায়ী, এটি চতুর্থ কন্যাসন্তান এবং অন্যটি তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান। কিন্তু রোববার যে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে বলে তাঁরা দাবি করছেন, তার বাহ্যিক অবয়ব ও লক্ষ্মণে সেটা এক দিন আগের নবজাতক বলে মনে হয়নি। ফলে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। আশপাশের লোকজনের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দেয়। পরে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পুত্রসন্তানটি প্রকৃত অর্থেই রুবেল-খাদিজা দম্পতির সন্তান নয় বরং এটি সাজ্জাদ-সানজিদা দম্পতির চুরি হওয়া সন্তান জুনায়েদ।
আটক রুবেল ও তাঁর শাশুড়ি শিশুটিকে চুরির কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন বলে জানান পুলিশ সুপার। পরপর চারটি কন্যাসন্তানের জন্ম হওয়া এবং পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষায় তাঁরা এ কাজ করেছেন বলে ধারণা পুলিশের। পুলিশ সুপার বলেন, হয়তো স্ত্রীকে খুশি করার জন্যও রুবেল মিয়া এ পথ বেছে নিতে পারেন।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে তাড়াইল থানায় মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আটক রুবেল ও তাঁর শাশুড়ি সত্তু বেগমকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
শিশু জুনায়েদের মা সানজিদা বলেন, ‘পুরো একটি দিন আমার কলিজার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেছিলাম। অবশেষে পুলিশের সহায়তায় সন্তানকে ফিরে পেলাম। আমি খুবই খুশি। তবে এমন ঘটনা যেন আর কারও সঙ্গে না ঘটে। সন্তানকে হারিয়ে কি যে কষ্ট লেগেছিল, সেটা বলে বোঝানো যাবে না।’