গানেই জীবনের আলো বাঁচিয়ে রেখেছেন বাদল
চোখে আলো নেই বাদল রায়ের। এ জন্য ভারী কাজ করতে পারেন না। তবে প্রতিবন্ধী হয়েও ভিক্ষাবৃত্তির পথে বেছে নেননি। বেঁচে থাকার হাতিয়ার করেন নিজের কণ্ঠকে। দোতারা হাতে শুরু করেন গানবাজনা। গানেই জীবনের আলো বাঁচিয়ে রেখেছেন বাদল। এই গানবাজনার আয় দিয়েই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন সংসার।
রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর হিন্দুপাড়ায় বাদল রায়ের বাড়ি। দিনমজুর বাবা অশনি রায়ের ঘরে আলো ছড়িয়ে ১৯৯০ সালে জন্ম হয় তাঁর। কিন্তু সেই আলো নিভে যায় বাদলের ৫ বছর বয়সে। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভুল ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বাদল দুচোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। অভাবের সংসারে বোঝা হয়ে যান তিনি।
বাদল রায় জানান, যখন তাঁর বয়স ১৩ বছর, তখন থেকেই কিছু করার চেষ্টা করেন। গানের আসর জমিয়ে হাটে ওষুধ বিক্রি কথা তিনি শুনতে পান। সেই দিনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, গান করবেন। বাবার কাছে বায়না ধরেন দোতরা কিনবেন। ২০০৬ সালে বাবা ৩০ টাকায় রংপুর শহর থেকে একটি দোতরা কিনে দেন। সেই দোতরা বাজিয়ে বাদল গান করা শুরু করেন। ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন হাটবাজারে ঘুরে ঘুরে গান করেন। এখন তাঁর গানের আয়েই বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী প্রতিমা রানী ও একমাত্র চার বছরের ছেলে তানু রায় এই ৫ সদস্যের সংসার চলছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তারাগঞ্জের ইকরচালী হাটে গানের আসর শেষে কথা হয় বাদল রায়ের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশের ভাও ভালো না। মানুষ আর আগের মতো গান শোনে না, টাকাও দেয় না। আগে সারা দিন দুই–তিনটা হাটে গান করে ৬০০ টাকা কামাই হইছিল। এখন ৩০০ টাকাও হয় না। খুব কষ্ট করি সংসার চালাচ্ছি। দুশ্চিন্তায় আছি, ব্যাটাটা স্কুলে ভর্তি হইলে তখন খরচ আরও বাড়বে। বাপের ওষুধ, সংসারে চাল, ছেলে খরচ কেমন করি জোগাড় করিম। মোর খুব ইচ্ছা, ছেলেটা লেখাপড়া করি বড় চাকরি করার।’
ভোটের সময় বাদল রায়ের চাহিদা বেড়ে যায়। লোকজন বাড়িতে এসে অগ্রিম নির্বাচনী গান করার জন্য তাঁকে বায়না করে যান। তখন দৈনিক আয় তাঁর ৩ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়। পাড়া–মহল্লা, গ্রামে তিনি অনেকে প্রার্থীর হয়ে গান গেয়েছেন। ওই প্রার্থীদের কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। তবে নির্বাচনের পর আর কেউ খোঁজ রাখেননি বলে জানান বাদল রায়।
ইকরচালী বাজারে কাপড় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বাদল দাদার গান শুনে আসছি। প্রায় হাটেই তিনি দোতরা হাতে নিয়ে গান বসান। আধুনিকতার ছোয়ায় স্মার্টফোনে সব কিছু মেলায় আগের মতো আর হাটে গানের আসরে মানুষ হয় না। তবে আমরা ব্যবসায়ীরা বাদল দাদার গান শুনে তাঁকে ১০–৫ টাকা দিই।’
বাদলের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য চান মিয়া বলেন, অন্য প্রতিবন্ধীদের চেয়ে বাদল ব্যতিক্রম। তিনি ভিক্ষা না করে গান গেয়ে সংসার চালান। বাদলকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।