‘বুড়া মানুষ কোনো কাজকামও করবার পাই না। আতত (হাতে) কুনো টেহাপইসাও নাই। আমরা গরিব মানুষ। বানের (বন্যা) পানি আইয়া আমার থাহুনের ঘরডাও ভাইঙ্গা থুইয়া গেছে। কই থাকমু, নিরুপাই অইয়া ভাঙ্গা ঘরই থাকতাছি।’
আকস্মিক বন্যায় নিজের একমাত্র বসতঘর ভেঙে যাওয়ায় আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার গড়াকুড়া গ্রামের বাসিন্দা রেজিয়া খাতুন (৭৫)। এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে রেজিয়া বলেন, ‘আপনেরা একটা ঘরের ব্যবস্থা কইরা দেইন। আল্লাহ আপনেগোরে ভালো করব। আমার তো আর থাহুনের কিছু নাই।’
এমন দাবি শুধু রেজিয়া খাতুনের একার নয়, তাঁর মতো যোগানিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের অনেক দরিদ্র বাসিন্দা এবারের বন্যায় ঘর হারিয়েছেন। ভাঙা ঘর মেরামতের জন্য তাঁরাও সরকারের কাছ থেকে সহায়তার দাবি জানিয়েছেন।
বন্যাপরবর্তী সময়ে ঘর হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এসব ভুক্তভোগীদের অনেকেই। অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। নিরুপায় হয়ে অনেকেই ভাঙা ঘরে কোনোরকমে রাত কাটাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অধিকাংশই দরিদ্র হওয়ায় নিজেদের অর্থে ঘর মেরামত করার সামর্থ্য নেই। তারা বসতঘর নির্মাণে সরকারের সহযোগিতার দাবি জানিয়েছে।
এক সপ্তাহে নালিতাবাড়ী উপজেলার চারটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। কমেছে ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ১৬টি গ্রামের ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দী আছে। রাজনগর ইউনিয়নের গ্রামগুলো থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। পানি কমতে থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বন্যার্ত লোকজন। এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে উপজেলায় ৫ হাজার ৮২৭টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যার পানি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় উপজেলাটিতে ১ হাজার ১৮০টি বসতঘর সম্পূর্ণভাবে এবং ৪ হাজার ৬৪৭টি বসতঘর আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
এদিকে জেলার বন্যা পরিস্থিতি এখন সার্বিকভাবে উন্নতির দিকে। এ বিষয়ে শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গতকাল সোমবার রাত নয়টার দিকে ভোগাই নদের পানি বিপৎসীমার ২৮৩ সেন্টিমিটার এবং চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ১২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এলাকার বাড়িঘরের পানি নেমে গেছে। তবে বাড়ির চারপাশে বন্যার পানি জমে থাকায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। তিনটি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের রাস্তার বিভিন্ন অংশ পানিতে ডুবে থাকায় পথচারীদের যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্থানীয় লোকজন।
গড়াকুড়া গ্রামের সুফিয়া বেগমের (৫০) স্বামী মারা গেছেন তিন বছর আগেই। তাঁর একমাত্র মেয়ে রাজধানী ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করেন। মেয়ের উপার্জনের অর্থেই সুফিয়ার সংসার চলে। ৫ অক্টোবর বন্যার পানিতে থাকার ঘরটি ভেঙে পড়ে। সেই ভাঙা ঘরেই পাঁচ বছরের এক নাতনিকে নিয়ে কষ্টে রাত পার করছেন তিনি। জানতে চাইলে সুফিয়া বলেন, ‘মেয়ে যে টেহা পাড়ায়, তা দিয়ে কোনো রহম দিন চলে। অহন ঘর ঠিক করমু কী দিয়া। আতে (হাতে) তো কুনো টেহাপইসাও নাই। গরিব অইয়া সব দিকেই বিপদ।’
যোগানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জমশেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ গ্রামের শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভেঙে গেছে। অনেক পরিবার নিরুপায় হয়ে ভাঙা ঘরেই থাকছে। তাদের অধিকাংশই অত্যন্ত গরিব। কোনো সহযোগিতা না পেলে হয়তো তাদের ঘর মেরামত করা সম্ভব হবে না।
বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন পরিবারগুলোর তালিকা কর্তৃপক্ষের পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারিভাবে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।