বাড়ির চালায় হিমালয়ান শকুন, সুস্থ হয়ে ফেরার অপেক্ষা
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল গ্রামের মো. সোলায়মান (৩০) পেশায় মুদিদোকানি। স্থানীয় মুনসিরহাটে তিনি ব্যবসা করেন। গত শনিবার দুপুরে একটি শকুন উড়ে এসে তাঁর ঘরের চালায় ছিটকে পড়ে। এরপর সোলায়মান আহত শকুনটিকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে রেখে শুশ্রূষা দিচ্ছেন। পরে জানা যায়, এটা একটি হিমালয়ান শকুন।
বুধবার দুপুরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বসতঘরের পাশের আরেকটি ঘরে শকুনটির সেবাযত্ন করছেন। কয়েক দিনের শুশ্রূষায় শকুনটি অনেকটা সুস্থ-সবল হয়ে উঠেছে। সোলায়মান প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের একটি ব্রয়লার মুরগি কেটে ছোট টুকরা করে শকুনটিকে খেতে দেন। খাবার দিতে গেলে শকুনটি তাঁকে ঠোকর দেয় না। তবে এমনিতে কাছে গেলে বা ধরলে ঠোকর দেয় আর তেড়ে আসে।
সোলায়মান বলেন, গত শনিবার দুপুরে ঘরের চালায় কিছু একটা পড়ার শব্দ পান তাঁর স্ত্রী। এতে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে বাইরে যান। গিয়ে দেখেন শকুনটি জবুথবু অবস্থায় পড়ে আছে। শকুনটি দেখে তাঁর স্ত্রী কিছুটা ভয় পেয়ে তাঁকে ফোন করেন। তিনি দ্রুত বাড়িতে এসে দেখেন, অসুস্থ শকুনটি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। এরপর তিনি কাছে গেলেও শকুনটি তাঁকে ঠোকর দেয়নি। পরে শকুনটিকে ধরে তিনি বসতঘরের পাশে একটি ঘরে রেখে বন বিভাগকে খবর দেন। পরে বন বিভাগের লোকজন শকুনটিকে পানি ও মুরগি খেতে দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত খাবার, পানি এবং শুশ্রূষা দিয়ে যাচ্ছেন।
শকুনটিকে শুশ্রূষা দেওয়ার চিন্তা কীভাবে এল? এমন প্রশ্নে সোলায়মান বলেন, ‘প্রাণীদের প্রতি এমনিতেই আমার মমতা বেশি। মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, আগে আমাদের দেশে অসংখ্য শকুন ছিল। এখন তা নেই। লোকমুখে শুনেছি, শকুন খুব উপকারী প্রাণী। তাই এটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করছি, যাতে শকুন আবার আমাদের দেশে ফিরে আসে।’
উদ্ধার হওয়া শকুনটি কোন প্রজাতির তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এর ছবি পাঠানো হয়েছিল ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও বন্য প্রাণীবিশেষজ্ঞ মো. জাহাঙ্গীর আলমের কাছে। তিনি বুধবার প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন এটি হিমালয় গৃধিনী (হিমালয়ান গ্রিফন) । ২০২১ ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভোলায় এই প্রজাতির দুটি শকুন উদ্ধার হয়েছিল। পরে তা বনে অবমুক্ত করেছিল বন বিভাগ।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর তথ্য অনুযায়ী, শকুন লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী। বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী, ২৬০টি শকুন টিকে থাকার তথ্য উঠে এসেছিল। এর সব কটিই ছিল বাংলা শকুন। এরপর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশ ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে দেশে শকুন রক্ষায় একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল। তাদের এক জরিপে ২০১৬ সালে সারা দেশে শকুনের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২০০টির মতো। শকুন মাত্রই বিশ্বে ‘মহাবিপন্ন’ (ক্রিটিক্যাল এনডেনজার্ড) প্রাণী।
বাকেরগঞ্জে এ শকুন পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, হিমালয় থেকে এ দেশের সমতল ভূমিতে আসতে হিমালয়ান শকুনকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। কোনো কোনো সময় পথটি দুই হাজার মাইলের বেশি। আবার এখানে এসে তারা সহজেই মরা প্রাণী খুঁজে পায় না। এতে পাখিগুলোকে বেশ কিছুদিন খাবার না খেয়ে থাকতে হয়। ফলে তারা দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। এই শকুনের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে।
বন বিভাগের বরিশাল রেঞ্জ কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান সাকিব বুধবার দুপুরে বলেন, শকুনটি অসুস্থ হওয়ায় সোলায়মানের বাড়িতে রেখেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে শকুনটির প্রতিদিনের খাবারের জন্য যে ব্যয় হয়, তা সোলায়মানকে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। উদ্ধার হওয়া শকুনটির ওজন প্রায় ১০ কেজি। শুশ্রূষায় এটি সুস্থ হলে সেখানেই অবমুক্ত করার ব্যবস্থা করা হবে। অন্যথায় বন্য প্রাণী ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করবেন।