বরিশালসহ দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচনকে ‘বৈধতা’ দেওয়ার জন্যই ইসলামী আন্দোলন অংশগ্রহণ করছে বলে মনে করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তাঁদের ভাষ্য, ইসলামী আন্দোলন কখনো বিরোধী দল, আবার কখনো সরকারি দলের সঙ্গে সহমত পোষণ করে নিজেদের সক্রিয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আকতার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে এই সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে সবাই বিশ্বাস করে, সেখানে এমনটা জেনেশুনেও ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা মানেই একে বৈধতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির ও চরমোনাই পীরের ভাই মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম অনেকটা আকস্মিকভাবেই প্রার্থী হয়েছেন। তিনি প্রার্থী হওয়ার পর থেকে বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নানা আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে কেন দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতাকে এখানে হঠাৎ প্রার্থী করা হলো, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বরিশালের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এ জন্য এখানে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। আর এই বিভেদের সুযোগ নিতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী তৎপর বলে অনেকেই মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ প্রশ্ন তুলেছে, যিনি বরিশাল সদর আসনে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন এবং ভবিষ্যতে করার প্রস্তুতি আছে, তাঁকে হঠাৎ মেয়র পদে দলটি মনোনীত করায় সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে।
বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন কারও নাম উল্লেখ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ক্রমে পরিষ্কার হচ্ছে, কোনো ঝানু খেলোয়াড় কলকাঠি নাড়ছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। এর জেরে ইসলামী আন্দোলন তাদের অন্যতম শীর্ষ নেতাকে এখানে প্রার্থী করেছে।’
তবে ইসলামী আন্দোলনের একটি সূত্র বলছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমিরকে প্রার্থী করার ঘটনার পেছনে দলটির নানা সমীকরণ রয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এবং নিজস্ব ভোটব্যাংক। এ তিন বিষয়কে দলটির নেতারা বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন। মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম ২০০৮ সালে বরিশাল-৫ (সদর উপজেলা ও সিটি এলাকা নিয়ে গঠিত) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।
ইসলামপন্থী দলটির নেতারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় বরিশালে বিএনপির যে বড় ভোটব্যাংক রয়েছে, তার আনুকূল্য পাবে ইসলামী আন্দোলন।
তবে বিএনপির নেতারা এতে দ্বিমত পোষণ করছেন। দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির ভোট পেতে এবার ইসলামী আন্দোলন কৌশল করছে। কিন্তু বিএনপি এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে যাবে না। আর যারা নির্বাচনে যাবে, তাদের বিএনপি কখনো বিরোধী দল বিবেচনা করে না।
মজিবর রহমান সরোয়ার আরও বলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন শুরু থেকেই নিজেদের সক্রিয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তারা (ইসলামী আন্দোলন) দেশের কোনো ইসলামপন্থী দলের সঙ্গেও নেই, আবার সরকারের বিরুদ্ধে কোথাও সরব, কোথাও নীরব, কোথাও আবার কম্প্রোমাইজ (আপস) করছে।’
এর আগে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনকে কাছে পেতে চেষ্টা করেছিল বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বরিশালের চরমোনাই দরবার শরিফের বার্ষিক মাহফিলে হাজির হয়েছিল। সেখানে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দুই দলের নেতাদের আলোচনা হয় এবং যুগপৎ আন্দোলনে ইসলামী আন্দোলনকে শামিল হওয়ার কথা তুললে দলটি তাতে সায় দেয়নি।
তবে ওই সময় বিএনপির নেতারা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁদের কোনো ‘দলীয় অ্যাজেন্ডা’ ছিল না। মাহফিলে আমন্ত্রণ পেয়েই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন।
তবে বিএনপির দলীয় একটি সূত্র জানায়, বিএনপি চাইছে, তাদের চলমান নির্দলীয় সরকারসহ ১০ দফা দাবির পক্ষে অন্য সমমনা দলগুলোর মতোই চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন শরিক হোক। দলটির লক্ষ্য, ১০ দফা দাবির সপক্ষে যত বেশি রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে, তত বেশি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই বিএনপির প্রতিনিধিদলটি ইসলামী আন্দোলনের মনোভাব বোঝার জন্য মাহফিলে গিয়েছিল।
ওই আলোচনায় অংশ নেওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন এ প্রসঙ্গে গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি সমস্ত রাজনৈতিক পক্ষকে নিয়ে এই সরকারের বদলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। সেই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করছে না। এর ব্যত্যয় ক্ষমতাসীন দলের জবরদস্তিমূলক ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতেই বৈধতা দেয়।
তবে ইসলামী আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আশরাফ আলী আকন গতকাল এসব বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি তাদের স্ট্র্যাটেজি অনুয়ায়ী রাজনীতি করে। এর সঙ্গে আমাদের রাজনীতি মিলবে না। বরিশালসহ পাঁচ সিটিতে আমাদের প্রার্থী থাকবে। আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাওয়ার উদ্দেশ্য, এখানে কিছু ভালো মানুষ জনপ্রতিনিধি হোক। তাতে মানুষ উপকৃত হবে।’
বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি মৌলিক দাবি হতে পারে না উল্লেখ করে আশরাফ আলী বলেন, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, এখনো পারবে না। এখন আওয়ামী লীগ চায় একদলীয় আর বিএনপি চায় নির্দলীয় সরকার। তবে ইসলামী আন্দোলন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য জাতীয় সরকার চায়।
সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে আশরাফ আলী আরও বলেন, ‘বিএনপিও তো সিটি নির্বাচনে অনেক জায়গায় বেনামে প্রার্থী দিয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে যাবে না বলে আবার গেছে। সংসদে তাদের দলীয় মহাসচিব যাননি, অন্যরা গেছেন। এটা কি তাহলে বৈধতা দেওয়া ছিল না?’