ঝালকাঠিতে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত আওয়ামী লীগ
ঝালকাঠিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমুর দিকনির্দেশনায় আওয়ামী লীগ এককাট্টা ছিল। বিভিন্ন নির্বাচনে তাঁর সমর্থনের বাইরে কেউ প্রার্থী হওয়ার সাহস দেখাতেন না। কিন্তু এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে।
সদরে এক প্রার্থীর উঠান বৈঠকে আওয়ামী লীগের আরেক প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা হয়েছে। হামলার ঘটনায় দুই প্রার্থীকে আসামি করে থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে নলছিটিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকে আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করছেন একই দলের আরও দুই নেতা। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।
দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে ব্যালটের মাধ্যমে ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগ এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করায় দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন। দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের তিনজন করে নেতা প্রার্থী হয়েছেন।
সদরে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতান হোসেন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খান আরিফুর রহমান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম; নলছিটিতে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জি কে মোস্তাফিজুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তছলিম উদ্দীন চৌধুরী ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন খান লড়ছেন।
সমর্থন ঘিরে বিভক্তি শুরু
দলীয় সূত্র জানায়, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। তাঁর পক্ষেই ঝালকাঠিতে আওয়ামী লীগ একসময় ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন নির্বাচনে তিনি যাঁকে প্রার্থী হিসেবে বাছাই করেছেন, তিনিই দলীয় প্রার্থী হয়েছেন। ২০১৬ সালে পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন তৎকালীন পৌর মেয়র আফজাল হোসেন। তখন তাঁর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এরপর আর কেউ দলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ঝালকাঠিতে প্রার্থী হননি।
নেতা-কর্মীরা জানান, এবারের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় সদর ও নলছিটিতে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রার্থী হন। কিন্তু আমির হোসেন আমু সদরে খান আরিফুর রহমান ও নলছিটিতে তছলিম উদ্দীন চৌধুরীকে তিনি সমর্থন দিয়েছেন বলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন। তাঁরা প্রার্থী হওয়ায় শুরু থেকেই নানা চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন।
সুলতান হোসেন খানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক রুহুল আমিন বরিশালে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, দলনিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। কিন্তু সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহে আলম, সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ সরাসরি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছেন। প্রভাব খাটিয়ে আমাদের নির্বাচন থেকে দূরে সরাতে চাইছেন। আমরা কিছুতেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব না।’
নলছিটিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের পর দুই প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও সালাউদ্দিন খান নির্বাচন কমিশনে আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেন। এর বাইরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও তাঁরা আমুর বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তছলিম উদ্দীন চৌধুরীকে সমর্থনের অভিযোগ করেছেন। নলছিটিতে এখন পর্যন্ত সংঘাত না হলেও পরিস্থিতির যেকোনো সময় অবনতি হতে পারে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমির হোসেন আমু আমাদের জাতীয় নেতা। তিনি দলের সবাইকে ভালোবাসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে কারও পক্ষ নেননি। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ।’ তিনি বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হওয়ায় নেতা-কর্মীরা স্বেচ্ছায় তাঁকে সমর্থন জানান। এখানে কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়নি।
পাল্টাপাল্টি হামলা ও মামলা
গত মঙ্গলবার রাতে ঝালকাঠি শহরের কীর্তিপাশা মোড়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী সুলতান হোসেন খানের পথসভায় হামলা হয়। হামলায় প্রার্থীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাঁরা ঝালকাঠিতে ফেরেন। চিকিৎসা শেষে সুলতান হোসেন খান শহরের চৌমাথার কামারপট্টির বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাঁর পক্ষে স্ত্রী কহিনুর খান ও মেয়ে বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করছেন।
হামলার ঘটনায় গত বুধবার বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি ও প্রেসক্লাবে সুলতান হোসেন খানের পক্ষে দুটি সংবাদ সম্মেলন হয়। হামলার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী খান আরিফুর রহমানের সমর্থকদের দায়ী করা হয়। লিখিত বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক রুহুল আমিন দাবি করেন, ‘ঝালকাঠিতে বর্তমানে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। হামলাকারীরা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মঙ্গলবারের হামলাকে তারা রিহার্সাল বলছে। আমরা খুবই আতঙ্কের মধ্যে আছি। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ কেউ আমাদের সহায়তা করছে না।’
তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে খান আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীর্তিপাশা মোড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সভায় কে বা কারা হামলা করেছে, আমি কিছুই জানি না। কীর্তিপাশা মোড়ে দোয়াত কলমের সমর্থকেরা আমার আনারস প্রতীকের অফিস ভাঙচুর করেছে।’
মঙ্গলবার রাতের হামলার ঘটনায় সুলতান হোসেন খান ও খান আরিফুর রহমানের পক্ষে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। হামলার ঘটনায় বুধবার সকালে প্রার্থীর ছোট ভাই হেমায়েত উদ্দিন খান বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় খান আরিফুর রহমানসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে খান আরিফুরের সমর্থক এনামুল হক বাদী হয়ে শহরের কীর্তিপাশা মোড়ে আনারস প্রতীকের কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন। মামলায় সুলতান হোসেন খান, রুহুল আমিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি দুটি মামলা করেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।