বিপন্ন ‘কুরুখ’ ভাষা রক্ষায় নতুন উদ্যোগ
টিলাটি খুব বেশি উঁচু নয়। তবে টিলায় ওঠার পথটি সরু, খাড়া। সেই টিলার ওপর উঠে দেখা গেল, একটি বাড়ির মাটির উঠানে চাটাই বিছিয়ে একদল ছেলেমেয়ে বসে আছে। গবেষক ও প্রভাষক দীপংকর শীল এসব শিশুকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘একাচে রাহাদায়’ (কেমন আছ)। শিশুরা জবাব দেয়, ‘নাগদিম রাদান’ (ভালো আছি)।
এই ভাষার নাম ‘কুরুখ’। এটি ওঁরাও বা উরাও জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। এসব শিশুর সবাই কুরুখ ভাষা শিখতে এসেছে। এখানে সপ্তাহে এক দিন তাদের মাতৃভাষার পাঠ দেওয়া হয়।
গত শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার দেওরাছড়া চা-বাগানের বাবনটিলায় খোলা উঠানে বসেছিল এই পাঠের আসর। এটা ওঁরাও জাতিগোষ্ঠীর উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত মাতৃভাষার স্কুল ‘কুরুখ ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র’। শিক্ষার্থীরা কুরুখ ভাষায় বিভিন্ন প্রাণী, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম শিখছে। সহভাষা বাংলা-ইংরেজিও শিখে নিচ্ছে। শিখিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষক আপন ওঁরাও। তিনি কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। স্বেচ্ছাশ্রমে সপ্তাহে এক দিন, শুক্র বা শনিবার বিকেলে শিক্ষাকেন্দ্রটিতে পাঠ দিয়ে থাকেন।
আপন ওঁরাওকে সহযোগিতা করেন কমলগঞ্জের পার্শ্ববর্তী মিরতিংগা চা-বাগানের মিঠুন ওঁরাও। তাঁরা দুজন একই কলেজের, একই শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাঁদের লক্ষ্যও এক। তাঁরা মাতৃভাষার চর্চাকে গতি দিতে চান, সমৃদ্ধ করতে চান।
কুরুখ ভাষার এই চর্চাকে সামনে আনার পেছনে কাজ করেছেন লোকগবেষক আহমদ সিরাজ, ভাষাবিজ্ঞানী সেলু বাসিত ও কুরুখ ভাষার গবেষক দীপংকর শীল। তাঁরা এই ভাষার বই, অভিধান তৈরি করেছেন। এখানে যারা ভাষা শিখতে আসে, তারা বিভিন্ন প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে ২০।
আপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে মা-বাবা, মুরব্বিরা সব সময় কুরুখ ভাষায় কথা বলেন। কিছু আছে লিখতে পারে, পড়তে পারে; তবে শুদ্ধ করে বলতে পারে না। অনেক জায়গায় মুরব্বিরা কুরুখ ভাষায় কথা বললেও শিশু-কিশোর, যুবকদের অনেকেই কুরুখ ভাষা জানে না, কথা বলে না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ভাষার চর্চা বাড়াতে এই উদ্যোগ।’
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, দেওরাছড়া চা-বাগানে ৩৭০ ওঁরাও জনগোষ্ঠীর লোক আছে। বাবনটিলায় আছে ১৫০ জনের মতো। মিরতিংগা চা-বাগানের হালকি টিলায় ৭০০ ওঁরাও জনগোষ্ঠীর বাস বলে মিঠুন জানালেন।
এই শিক্ষাকেন্দ্রে এসে কুরুখ ভাষায় পশুপাখির নামসহ অনেক কিছু শিখেছে বলে জানাল নবম শ্রেণির ছাত্রী সীমা ওঁরাও। সে বলে, ‘আমার মা-বাবা কুরুখ ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু আমরা বাইরে অন্য ভাষার লোকদের সঙ্গে কথা বলি। তাই কুরুখ ভাষায় কম কথা হয়। এখন নিজেদের মধ্যে কুরুখ ভাষাতেই কথা বলি।’
জগবন্ধু ওঁরাও নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘নিজের ভাষায় কথা বললে আমাদের যে আলাদা পরিচয় আছে, এটা বোঝা যায়।’
শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কুরুখ ভাষা শেখানোর পরামর্শটা আসে ভাষাবিজ্ঞানী সেলু বাসিতের কাছ থেকে। তাঁর পরামর্শেই দীপংকর শীল ‘কুরুখ ভাষা শেখার প্রথম পাঠ’ রচনা করেন। ২০২২ সালের ৩ মার্চ লোকগবেষক আহমদ সিরাজের বাড়িতে স্কুলপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সে বছরই ৩০ সেপ্টেম্বর বাবনটিলার লালসাই ওঁরাওয়ের বাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং ওই বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ক্লাস শুরু হয়।
গবেষক দীপংকর শীল বলেন, ‘কুরুখ দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের একটি শাখা। বাংলাদেশে কুরুখ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। কুরুখ ভাষায় লোকসংগীত, গল্প, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদির চর্চা আছে। ভাষাটি এখন বিপন্ন। অনেকে ভুলতে বসেছে। তবে ভারতে “তোলং সিকি” নামে ওঁরাও জনগোষ্ঠীর লিপি আছে। ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, কমলগঞ্জে ওঁরাও জনসংখ্যা ৩ হাজার ১৩৮।’
আপন পাঠদানের জন্য একটি স্থায়ী ঘরের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এক বছরের ওপর নিজেরা স্কুল চালিয়েছি। এখন একটা ঘর দরকার। সরকারি সুযোগ-সুবিধা মিললে মাতৃভাষা, নিজেদের সংস্কৃতিটাকে টিকিয়ে রাখা সহজ হবে।’