মেডিকেলে পড়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় মেয়ে, বাবা-মায়ের চোখে জল
রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফট অপারেটর হিসেবে কাজ করেন আবদুল কাদের (৫৫)। স্বল্প আয়ের সংসারে সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন বুনছিলেন তিনি। কিন্তু দারিদ্র্য সেই স্বপ্নপূরণে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
কিছু মানুষের সহযোগিতায় গত বছর বড় মেয়েকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছিলেন। এখন সেমিস্টার ফি ও ভর্তির বাকি টাকা পরিশোধ করার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। মেয়ের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নের খুব কাছে ফিরতে হতে পারে, ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা।
আবদুল কাদেরের দুই মেয়ে, দুই ছেলে। বড় মেয়ে মানসুরা আক্তার সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে পড়ছেন। মেজ মেয়ে ঢাকার আজিমপুরে অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। এক ছেলে স্কুলশিক্ষার্থী, অন্যজনের বয়স সাড়ে ৩ বছর। স্ত্রী রীতা আক্তার কাদের নিজের কর্মস্থল ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আয়া হিসেবে কাজ করেন। মেয়ে মানসুরা সাভারে থাকেন। ঢাকার রায়েরবাজারে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ভাড়া বাসায় গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। স্বামী-স্ত্রীর আয়ে টেনেটুনে চলছে সংসার।
আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকে চিকিৎসক হতে চাইত মানসুরা। এইচএসসি পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হতে চায়। মেয়েকে তিনি বলেছিলেন, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলে যেভাবে হোক ভর্তি করাবেন। তিনি ভেবেছিলেন, কোনো কোচিং করেননি, প্রাইভেট পড়েননি, সুযোগ পাবেন না। কিন্তু মানসুরা সুযোগ পেয়ে যান। ভর্তির জন্য ১৫ লাখ টাকা লাগবে জানার পর কর্মস্থলের সবার সহযোগিতা নিয়ে তিন লাখ টাকা জমা দিয়ে মেয়েকে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান। বাকি ১২ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য সময় নিয়েছেন। মেয়ের পড়াশোনা শেষ করতে সেমিস্টার ফিসহ মোট সাড়ে ২৮ লাখ টাকা প্রয়োজন। এখন এত টাকা কোথায় পাবেন, জানেন না।
আবদুল কাদের বলেন, ‘অনেকেই বলেছেন, “আমরা গরিব, এত টাকা খরচ করে মেয়েকে পড়ানোর কী দরকার?” আবার অনেকে ভরসা দিয়ে বলেছেন, “সবাই তো চান্স পায় না; তোমার মেয়ে চান্স পেয়েছে, তুমি কষ্ট করে হলেও ভর্তি করাও।” এখন কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু গর্বও হচ্ছে। একসময় আমি বলতে পারব, আমি লিফটম্যান আর আমার মেয়ে ডাক্তার।’
আর্থিক সংকটে পড়াশোনা বন্ধের শঙ্কা মানসুরার চোখেমুখে স্পষ্ট। কথা বলতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছিলেন। মানসুরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন তো সাহায্য না পেলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। বাবা-মা কষ্ট করে ভর্তি করাইছে, এখন যদি টাকার জন্য পড়তে না পারি, তাহলে সবার স্বপ্ন ভেঙে যাবে। আমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, খরচ কমাতে কলেজের হোস্টেলে না থেকে পাশের এলাকায় দুজন মিলে বাসা নিয়ে থাকছেন। চার–পাঁচ হাজার টাকায় মাস চলছেন। টাকা বাঁচাতে ক্লাসের বিরতিতে বাসায় গিয়ে রান্না করে খান।
আবদুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে বসে ছিলেন স্ত্রী রীতা আক্তার। কয়েকবার ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছতে দেখা গেল।
রীতা আক্তার বলেন, ‘দুজনে চাকরি করে যা পাই, বাসাভাড়া, খাবার খরচেই শেষ হয়ে যায়। ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিছি। মেয়েটা ডাক্তারি পড়তেছে। আমাদের তো সামর্থ্য নাই। স্যাররা জানার পর বলছিল, যেভাবেই হোক মেয়েকে ভর্তি করাতে। বড় আশা নিয়া সবার সহযোগিতায় ভর্তি করাইছিলাম। এখন তো অন্ধকার দেখতেছি। সবার প্রতি অনুরোধ, আপনারা একটু সহযোগিতা করেন। আমার মেয়েটার স্বপ্ন ভাঙতে দিয়েন না।’