বগুড়ায় এক মাসে চার খুন, জনমনে আতঙ্ক
বগুড়া শহরে হঠাৎ চুরি, ছিনতাই, খুনোখুনি বেড়েছে। প্রকাশ্যে দিনদুপুরে ঘটছে খুনের ঘটনা। গত এক মাসে শহরে অন্তত চারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এখন রাত নামলেই ছিনতাই ও চুরির ঘটনা ঘটছে। অপরাধ কর্মকাণ্ডে বেড়েছে চাকু, ছুরি ও ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর দাবি, অন্য সময়ের চেয়ে বগুড়ার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। তিনি যোগদানের পর থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
ঠুনকো কারণেও খুনোখুনি
বিলিয়ার্ড খেলা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে গত শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে শহরের নামাজগড় এলাকার একটি বিলিয়ার্ড সেন্টারে জুনায়েদ আল হাবিব ওরফে বিপুল (২১) নামের এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ উঠে। জুনায়েদ শহরের বাদুরতলা এলাকার বাসিন্দা এবং একটি ছাপাখানার কর্মচারী ছিলেন।
বগুড়া সদর থানার পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নামাজগড় এলাকার ‘ব্রেক অ্যান্ড রান’ নামে একটি বিলিয়ার্ড সেন্টারে শুক্রবার সন্ধ্যায় খেলতে যান জুনায়েদ। সেখানে খেলা নিয়ে কয়েকজন তরুণের সঙ্গে তাঁর বাগ্বিতণ্ডা হয়। হাতাহাতি শুরু হলে বিলিয়ার্ড সেন্টারের মালিক আরিফ দুই পক্ষকে থামাতে আসেন।
এ সময় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আরিফের গালে থাপ্পড় লাগে। এ সময় আরিফ সেখানে থাকা একটি ছুরি ওই যুবকদের হাতে দিলে সেটি দিয়ে তাঁরা জুনায়েদকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানকার চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন আসামি গতকাল শনিবার বগুড়ার একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এর আগে ১ নভেম্বর সকালে বাসা থেকে আদালতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন শিক্ষানবিশ আইনজীবী আবদুল বারী ওরফে চাঁন মিয়া মণ্ডল। বগুড়া শহরের চক ফরিদ এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা তিন ব্যক্তি তাঁর পথ রোধ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন।
গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার দিন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকার পর ৪ নভেম্বর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। চাঁন মিয়া মণ্ডল বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাবেক সদস্য ছিলেন।
এরপর ৪ নভেম্বর রাতে বগুড়া শহরের গোদারপাড়া এলাকায় উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয় কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এসএসসি ভোকেশনাল কোর্সে নবম শ্রেণির ছাত্র রবিউল ইসলাম ওরফে রবিন (১৫)। সন্ত্রাসীরা ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করে রবিউলকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় রবিউল ইসলামের বাবা নওশাদ আলী বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা করেন।
তারও আগে গত ৮ অক্টোবর শহরের কইগাড়ি এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হন জাকির হোসেন (৪৮) নামের অবসরপ্রাপ্ত এক সেনাসদস্য। তাঁর বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নের সাচিয়াখালি গ্রামে। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি সপরিবার বগুড়ায় বসবাস করতেন।
বেড়েছে ছিনতাই ও চুরি
শহরের বিভিন্ন স্থানে রাত নামলেই ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয়েছে অনেক পথচারীকে। এসব ক্ষেত্রে আইনি ঝামেলা ও ভোগান্তির এড়াতে থানায় অনেকেই অভিযোগ দেন না। আবার অভিযোগ করেও তেমন লাভ হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন ছিনতাইকারীরা।
১ নভেম্বর রাতে শহরের সাতমাথা-বনানী সড়কের সরকারি শাহ সুলতান কলেজসংলগ্ন রেশমবাগানের সামনে ভারতীয় নাগরিকসহ দুজন ছিনতাইয়ের শিকার হন। তাঁরা হলেন—শাজাহানপুর উপজেলার গণ্ডগ্রাম এলাকার পা-ওয়াং সিরামিকস কারখানার কর্মকর্তা হারগোবিন্দ জখুরাম ভার্মা ও ব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান।
থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, ছিনতাইকারীরা এ দুজনের পথ রোধ করে অস্ত্রের মুখে ১৭ হাজার টাকা, ৫ হাজার ভারতীয় রুপিসহ ২টি স্মার্টফোন, পাসপোর্ট ও ল্যাপটপের ব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে যান। এ বিষয়ে থানায় মামলার পর ভারতীয় নাগরিকের পাসপোর্ট রেশমবাগান থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
এর আগে ১৬ অক্টোবর শহরের সাতমাথা-তিনমাথা সড়কের সেউজগাড়ি বালুর মাঠে দিনদুপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হন সরকারি আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তূর্য তাহসিন মো. তুষার (২০)। এ সময় স্থানীয় লোকজন চাকুসহ এক ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
৬ নভেম্বর রাতে শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠ সড়কের মসজিদ মার্কেটে হাবিব স্টোর নামের একটি দোকানে তালা ভেঙে চুরি হয়। চোরেরা দোকানের অনেক মালামাল নিয়ে যান। পুলিশ সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করলেও এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
যা বলছে পুলিশ ও নাগরিক সমাজ
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া শহরের আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের জনবল অত্যন্ত কম। সদর থানায় পুলিশের সংখ্যা ৯২। এই সীমিত জনবল নিয়ে শহরের সাত-আট লাখ নাগরিক ছাড়াও সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে সীমিত এই জনবল দিয়েই অপরাধ দমনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বগুড়ার সভাপতি মাসুদার রহমান বলেন, বগুড়া শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নজিরবিহীন অবনতি ঘটেছে। দিনেও খুনখারাবি, ছিনতাই হচ্ছে।
রাত নামলেই বাড়ছে আতঙ্ক। শহরের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ নাগরিকেরা উদ্বিগ্ন। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতাও বেড়েছে। কিশোর-তরুণদের হাতে হাতে প্রাণঘাতী চাকু মিলছে। অপরাধ দমনে পুলিশের তৎপরতা মোটেও আশ্বস্ত হওয়ার মতো নয়।