৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চলমান চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট নিরসনে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে আগামীকাল বুধবার ঢাকায় দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করবে শ্রম অধিদপ্তর। এদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিকনেতারা।
আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সম্মেলনকক্ষে চা-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চা-বাগান শ্রমিক ভবিষ্যৎ তহবিলের নিয়ন্ত্রক (উপসচিব) শেখ কামরুল ইসলাম, পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন, মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. শাহীনা আক্তার, হবিগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান, হবিগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন) শৈলেন চাকমা, সিলেট এনএসইআই যুগ্ম পরিচালক বজলুর রহমান, উপপরিচালক দাদন মুন্সী, বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুর রহমান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সন্দ্বীপ তালুকদার এবং শ্রম কর্মকর্তা মোসাহিদ চৌধুরী।
চা-শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা পরাগ বারই, সভাপতি মাখন লাল কর্মকার, সহসভাপতি পংকজ কন্দ, সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দিসহ বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও বিভিন্ন ভ্যালির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
দুপুরের বিরতি দিয়ে বিকেলে আবার আলোচনায় বসেন তাঁরা। সেখানেও কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছাতে পেরে দুই পক্ষকে নিয়ে ঢাকায় সভা করার সিদ্ধান্ত নেন মহাপরিচালক।
সভায় চা-শ্রমিক নেতারা তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তুলে ধরেন। সভায় শ্রমিক নেতারা বলেন, চা-শ্রমিকেরা ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকেরা হিমশিম খাচ্ছেন। ভালো খাবার কেনার টাকা তাঁদের নেই। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য বিভিন্নভাবে ঋণ করতে হয়। চা-বাগানের চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই খারাপ। কোনো রোগী অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। গত করোনাকালীন সবকিছু যখন বন্ধ, তখন চা-শ্রমিকেরা জীবন বাজি রেখে চা–শিল্পের জন্য কাজ করেছে। কোনো চা-বাগান করোনার সময় বন্ধ হয়নি।
নারী চা-শ্রমিক নেত্রীরা বলেন, চা-বাগানে নারী শ্রমিকদের শৌচাগার নেই। এ জন্য চা-বাগানের ভেতরেই শৌচকর্ম সারতে হয়। চা-বাগানের নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি কম পান, গর্ভবতী নারীরা পেটে সন্তান নিয়েও কাজ করেন। চা-বাগানের বেশির ভাগ মানুষ ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে থাকেন। এই অবস্থায় যদি এত কষ্ট করে কাজ করেও মজুরি বৃদ্ধি না হয়, তাহলে তাঁরা চা-বাগানের কাজ করবেন না।
বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, ‘আমরা এখানে আলোচনায় এসে অবাক হয়েছি। আজ আমাদের অনেক প্রোগ্রাম ছিল। আমাদের শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আমরা বড় বড় শহরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করার কথা ছিল। এখানে সমঝোতা বৈঠক শুনে আমরা এসেছিলাম। এখানে আমাদের দাবি না মেনে উল্টো আমাদের আন্দোলন বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে। ২৩ তারিখ তাঁরা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আমরা এটা মানছি না। যত দিন দাবি মানা না হবে, আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালি সভাপতি বিজয় হাজরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছে বলে আমরা এখানে আলোচনায় এসেছি। এখানে আমাদের শ্রমিকনেতারা তাঁদের সমস্যা ও বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন। কিন্তু মজুরির বিষয়ে মহাপরিচালক কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি। তিনি আমাদের আন্দোলন বন্ধ রেখে ২৩ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছিলেন, আমরা সেটা মানিনি। পরে তিনি আমাদের কাল বুধবার ঢাকায় আলোচনায় বসতে বলেন। সেখানে মালিকপক্ষও থাকবে।’
বিজয় হাজরা বলেন, চা–শ্রমিকেরা ১০-১৫ কিলোমিটার হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আন্দোলন করছেন। এটা তাঁদের রুটিরুজির লড়াই। শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে কম মজুরিতে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। এই আন্দোলন শ্রমিকদের বাঁচামরার আন্দোলন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
এদিকে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের বলেছি সবার স্বার্থে আপাতত আন্দোলন বন্ধ করতে। আগামী ২৩ তারিখ মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ ও আমরা তিন পক্ষ মিলে সভায় সবার কথা তুলে ধরবেন। এই মুহূর্তে মালিকেরা কত টাকা মজুরি দেবে, সেটা বলার এখতিয়ার আমার নেই। সেটা আলোচনায় বসে তারা দুই পক্ষ ঠিক করবে। দরকার হলে বারবার আলোচনা হবে। আমরা চাই একটি শ্রমবান্ধব পরিবেশ, শিল্পবান্ধব পরিবেশ।’