চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা সালাম ছিলেন বিএনপি নেতা আলম হত্যা মামলার আসামি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নে গতকাল বৃহস্পতিবারের জোড়া খুনে এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে।
উপজেলার রাণীহাটি ডিগ্রি কলেজের সামনে গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে ওই দুজনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন জেলা পরিষদের সদস্য ও শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম (৫৫)। তিনি ইউপি সদস্য ও স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. আলম হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। নিহত অন্যজন হলেন একই উপজেলার ফতেপুর গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে আবদুল মতিন। তিনি হরিনগর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
আজ শুক্রবার সকালে নয়ালাভাঙ্গা মোড়লপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সালামের বাড়ির সামনে নারী-পুরুষের ভিড়। স্বজনেরা আহাজারি করছেন। চেয়ারে বসেছিলেন কয়েকজন ব্যক্তি। সেখানে কথা হয়, সালামের ছোট ভাই শরিফুল ইসলামের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্ত্রী ও তিন ছেলেকে রেখে গেল আমার ভাই। বড় ছেলেটা এসএসসি দিয়েছে। মেজ ছেলে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এখন বাপহারা ছেলেদের লেখাপড়া কেমন করে হবে কে জানে।’
সেখানে বসে থাকা সালামের চাচাতো ভাই আবদুল মান্নান বলেন, ‘যখন সালামের ওপর হামলা হয়, তখন আমি ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলাম। অন্তত ২০টি গুলি ও বহু ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি। সালামের সারা শরীর গুলি করে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়। ককটেল বিস্ফোরণও ঘটানো হয় শরীরে। এরপর চায়নিজ কুড়াল দিয়ে কোপানোও হয়।’ তিনি বলেন, বিএনপি নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলামের নির্দেশে সালামকে হত্যা করা হয়। সেখানে উপস্থিত থাকায় স্কুলশিক্ষক আবদুল মতিনকেও গুলি করে মারা হয়। এর আগে ২৪ মার্চ রাতেও সালামকে বহন করা প্রাইভেট কারে গুলি ও ককটেল হামলা চালিয়েছিল প্রতিপক্ষের লোকজন। ভাগ্যক্রমে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাঁচতে পারলেন না।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিবদমান দুটি পক্ষ রয়েছে। এর একটি পক্ষের নেতা ছিলেন নিহত সালাম। ১৪ মাস আগে ইউপি সদস্য ও স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. আলম খুন হন। ওই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন তিনি। এর আগে আলম হত্যা মামলার আরেক আসামিকে হত্যা করা হয়।
পাশের ফতেপুর গ্রামে নিহত স্কুলশিক্ষক মতিনের বাড়িতে গিয়েও আত্মীয়স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া মতিনের ছেলে মশিউর রহমান (১৯) বলেন, তাঁর বাবা কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পাওনা টাকা শোধ দেওয়ার জন্য সালাম ডেকেছিলেন বলে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মশিউর বলেন, ‘আমি বাবা হত্যার বিচার চাই। কিন্তু মামলা করতে ভয় পাচ্ছি। যদি আমাকেও মেরে ফেলে সন্ত্রাসীরা। আমিই একমাত্র ছেলে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার এক বোন আছে। আমার কিছু হলে মা কাকে অবলম্বন করে বাঁচবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমার জাপান যাওয়ার কথা। এর মধ্যে জাপানি ভাষা শিখেছি। ৭ জুলাই ঢাকায় পরীক্ষা। এখন সবকিছু অনিশ্চিত।’
এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিবগঞ্জ এখন সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত। গত ২০-২৫ বছরে এই ইউনিয়নে ১০টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটেছে। এর মধ্যে গত ১৪ মাসে চারজন নিহত হলেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোকজন রয়েছেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকেই এসব হত্যাকাণ্ড ও বহু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী লোকেদের ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি ও মাদকের বিস্তার ঘটেছে। এ নিয়ে বিবদমান পক্ষগুলো মাঝেমধ্যেই ককটেল ফাটিয়ে এলাকার লোকজনকে সন্ত্রস্ত করছে। এসব দমনে প্রশাসন বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাকুল ইসলাম শেষ চারটি হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও রাজনীতি দুটোই আছে।
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেনও বলেন, সালামসহ চারটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধই কারণ। তবে এর আগের অন্য হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানা নেই। সালাম ও মতিনের লাশের ময়নাতদন্ত ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।