২১ বছর আগের যে হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না পরিবারও
চট্টগ্রামের শিপিং ব্যবসায়ী রেজাউর রহমান জাকিরকে যখন গুম করে খুন করা হয়েছিল, তখন তাঁর ছেলে শেফাউর রহমানের বয়স ছিল ১০ বছর। যুক্তরাজ্য থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে ছেলে এখন চাকরি করেন বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোলস-রয়েসে। ৩২ বছর বয়সী সেই ছেলে এখন বাবা হত্যার বিচার চান না। একই বক্তব্য নিহত রেজাউরের স্ত্রী নাসিমা রহমানেরও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২১ বছরেও কিছু হয়নি। আর বিচার চাই না। ওপরওয়ালার কাছে বিচার দিয়েছি।’
গত ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের খুলশী গরিব উল্লাহ হাউজিং এলাকার বাসায় বসার ঘরে যখন নাসিমা রহমান এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক আর হতাশা । তিনি বারবার শুধু একটি কথাই বলছেন, ‘এখন কী আর হবে। সন্তান নিয়ে একটু নিরাপদে বাঁচি।’ স্বামী হত্যার বিচার নিয়ে কোনো হুমকিতে আছেন কি না, প্রশ্নের উত্তরে কোনো জবাব দেননি তিনি।
নাসিমার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর পাশে ছিলেন তিন সন্তানের মধ্যে ছেলে শেফাউর রহমান ও ছোট মেয়ে তেসিন তাবাসসুম রহমানও। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে। বসার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আট ভাইয়ের সঙ্গে তোলা রেজাউরের একটি ছবি। কিছুক্ষণ পরপর স্ত্রী, সন্তানেরা রেজাউরের সেই ছবির দিকে তাকাচ্ছেন আর চোখ মুছছেন। কিন্তু বাবার হত্যা ও বিচার নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। কেউ আর বিচার চান না। সবার মধ্যে ক্ষোভ আর হতাশা।
আদালত সূত্র জানায়, ২১ বছর আগে করা রেজাউরকে গুম করে খুনের মামলাটির বিচার শুরুই হয়নি। জামিনে রয়েছেন গ্রেপ্তার সব আসামি। কিন্তু ঘটনায় জড়িত মূল আসামিদের নাম তদন্তে না আসায় এই মামলার বিচার আর চায় না রেজাউরের পরিবার।
আমদানি করা পুরোনো জাহাজ বেচাকেনার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওশেন ট্রেড ব্রোকার্স লিমিটেডের (ওটিবিএল) কর্ণধার ছিলেন রেজাউর রহমান।
রেজাউর যখন খুন হয়েছিলেন, তখন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ছিলেন আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। বর্তমানে বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের অনারারি কনসাল তিনি। রেজাউর খুনের কোনো কিনারা না হওয়ায় হতাশ আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার সময় অনেকের নাম উঠে এসেছিল। আমরাও নানাভাবে প্রকৃত আসামিকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না।’
কী ঘটেছিল সেদিন
২০০৩ সালের ১১ আগস্ট। সেই দিন নগরের খুলশীর বাসা থেকে বের হয়ে আগ্রাবাদে অফিসের উদ্দেশে মাইক্রোবাসে রওনা হন ব্যবসায়ী রেজাউর রহমান। যাওয়ার সময় তাঁর খালাতো শাশুড়িকে ট্রেনে তুলে দিতে যান। সঙ্গে ছিলেন শ্যালক মো. সুজন। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে গাড়িটি পার্কিংয়ে রেখে শ্যালক তাঁর মাকে ট্রেনে তুলে দিতে যান। ফিরে এসে দেখেন গাড়িটি পার্কিংয়ে নেই।
বিকেল পাঁচটার দিকে পরিবার থেকে খবর নেওয়া হয় রেজাউর আগ্রাবাদের অফিসে যাননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ওই দিন পরিবারের পক্ষ থেকে খুলশী থানায় জিডি করা হয়। পরদিন (২০০৩ সালের ১২ আগস্ট) পুলিশের মাধ্যমে খবর পাওয়া যায়, জেলার বোয়ালখালী শাকপুরা মিলিটারি ব্রিজের পাশে কচুরিপানার ভেতর ভাসছে রেজাউরের লাশ। পরে পরিবারের লোকজন ও পুলিশ হাত-পা বাঁধা লাশটি উদ্ধার করে। লাশের মাথার পেছনে আগ্নেয়াস্ত্রের আঘাত ছিল। এই ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই মিজানুর রহমান বাদী হয়ে খুলশী থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
পাঁচ বছরের তদন্ত, নারাজি
ঘটনার পর পাঁচ বছর তদন্ত শেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই মামলায় ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এতে নগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান, নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলম, আবু তাহের, আবদুল হালিম, মো. বশির, মো. রব্বানী, মো. কামাল, মো. সাহাবুদ্দিন ও মো. জাহাঙ্গীরকে আসামি করে। এর আগে হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, মো. শফি ও ইয়াহিয়াসহ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়।
সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন মামলার বাদী মিজানুর রহমান। এতে বলা হয়, জাহাজসংক্রান্ত বিরোধের জেরে খুন করা হয় রেজাউরকে। কিন্তু অভিযোগপত্রে এমন সব ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। এই কারণে নারাজি আবেদন করে পুনরায় তদন্তের জন্য বলা হয়েছে।
পরের বছরের ২৩ এপ্রিল আদালত নারাজি আবেদন নামঞ্জুর করে সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। বিচার শুরুর জন্য আদালত পলাতক কয়েকজন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন। এই অবস্থায় বাদী অভিযোগপত্র গ্রহণের আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। সেখানে তা নামঞ্জুর হলে উচ্চ আদালতে যান। ২০১২ সালের ১৩ এপ্রিল উচ্চ আদালত ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। পরে এটি বর্ধিত হয়। শেষ চলতি বছরের গত ২২ সেপ্টেম্বর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলার ধার্য দিন ছিল। ৩০ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী ধার্য দিন রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা কোর্ট পরিদর্শক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আদালত আগামী ধার্য দিনে মামলার বাদীকে উচ্চ আদালত থেকে নেওয়া স্থগিতাদেশের সর্বশেষ আদেশের অনুলিপি উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলাটির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে জানান মামলার বাদী মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেজাউরের পরিবার ও আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।’
তিনটি স্ক্র্যাপ জাহাজ ও খুনের রহস্য
রেজাউর হত্যার বিচার হোক, চান আসামি বিএনপি নেতা শাহ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিপিং ব্যবসাসংক্রান্ত বিরোধে খুন করা হয় শুনেছি। পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাদের কেন আসামি করেছে জানি না। বাদীও তাঁর আপত্তি করেছেন।’
খুন হওয়ার কিছুদিন আগে তিনটি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করেন রেজাউর রহমান। তাঁকে খুনে জাহাজ আনার বিষয়টি উঠে এসেছিল সেই সময়। রেজাউরের ব্যবসায়িক অংশীদার, তিনজন শিপিং ব্যবসায়ীর নামও আলোচনায় ছিল তখন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত রেজাউরের স্ত্রী নাসিমা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ থেকে শুরু করে সবাই জানে কেন খুন করা হয়েছে। এখন ওই সব বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে চাই।’