গ্রামে ফেরি করে ভাঙারি জিনিসপত্র কিনে তা বিক্রি করে সংসার চালাতেন মো. সেলিম আলী সেক (৩৬)। অভাবের সংসারে বাবার মাত্র ২ শতাংশ ভিটেমাটির দুটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতেন সবাই। নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভাব ঘুচিয়ে একখণ্ড জমি কিনে নতুন একটি ঘর করার স্বপ্ন ছিল সেলিমের। তাই স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। নিজে ভাঙারি ব্যবসা করেন। স্ত্রীকে গৃহকর্মীর কাজে লাগান। আর ছেলেকে প্রথমে দোকানে ও পরে পোশাক কারখানায় কাজে দেন। পরিবারের অভাব রেখেই চিরবিদায় নিতে হয়েছে সেলিমকে।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মো. সেলিম আলী সেক। তিনি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ধারা ইউনিয়নের আশ্রমপাড়া গ্রামের কলিম উদ্দিন সেকের (৭০) ছেলে। তাঁর মায়ের নাম সখিনা বেগম (৫৫)। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন সেলিম। তাঁর স্ত্রীর নাম আসমা খাতুন (৩০)। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মেয়ে কুলসুম বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন বছরখানেক আগে। বড় ছেলে মো. শাওন মিয়া (১৫) পোশাক শ্রমিকের কাজ করেন। আর ছোট ছেলে আরিয়ানের বয়স তিন বছর।
সেলিম আলী এলাকায় ফেরি করে ভাঙারি জিনিসপত্র কিনতেন। সংসারের অভাব ঘোচাতে আট বছর আগে মিরপুরে চলে যান। সেখানে গিয়েও ফেরি করে ভাঙারি জিনিসপত্র কিনতেন। শুধু সেলিম নন, তাঁর ছোট দুই ভাই সাত্তার সেক ও আক্কাস সেকও ভাঙারি জিনিস কেনাবেচা করেন। সাত্তার সেকও বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে মিরপুরে থেকে ভাঙারি ব্যবসা করতেন। আর আক্কাস গ্রামের বাড়িতে মা–বাবার সঙ্গে থেকে ভাঙারি ফেরি করেন।
পরিবার ও স্বজন সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলছিল। ঝুটপট্টি এলাকায় নিজের ভাড়া বাসার সামনে সেদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত দোকানে বসে ছিলেন সেলিম। পরে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘণ্টাখানেক পর স্বামীর খোঁজ করতে গিয়ে তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ পাচ্ছিলেন স্ত্রী আসমা খাতুন। আশপাশে যখন খোঁজ শুরু হয়, সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে স্থানীয় লোকজন জানান, সেলিম গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। স্থানীয় একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে সেলিমের লাশ শনাক্ত করেন ছোট ভাই সাত্তার সেক। পরে সেখানে সেলিমের স্ত্রী-সন্তানসহ অন্যরা যান। তাঁরা জানতে পারেন, সেলিমের পেটের ডান পাশ দিয়ে গুলি লেগে বাঁ পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তিনি মারা গেছেন। পরে রাতেই সেলিমের লাশ গ্রামের বাড়ি হালুয়াঘাটে নেওয়া হয়। ২০ জুলাই সকালে বাড়ির পাশে একটি গোরস্তানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
সেলিম আলী সেকের বাবার ২ শতাংশ জমির ভিটেমাটি। সেখানেই দুটি জীর্ণ ঘরে পুরো পরিবারের লোকজন থাকেন। মুঠোফোনে আলাপকালে আক্ষেপ করে নিহত সেলিমের স্ত্রী আসমা খাতুন বলেন, ‘অভাব ঘুছায়া একটু জায়গা কিনমু, বাড়ি করমু এর লাইগ্যা ঢাকা আইছিলাম। কিন্তু আল্লায় তা দিল না, অহন কি করবাম। আল্লায় তারে (সেলিম) নিয়া খুশি অইছে, আমিও খুশি। আল্লায় যেন তারে শান্তিতে রাহে।’
আসমা খাতুন বলেন, ‘অভাবের কারণে দেশ ছাড়ছিলাম। পোলাপানরে লেহাপড়া করাইতে পারলাম না, পোলারে ছুডু থাকতেই কামে দিছি। এহন আল্লায় যে হালে চালায়, হেই হালেই চলব। এই হানে ৬ হাজার টাকা ঘর ভাড়া। ছুডু বাবুরে নিয়া কাম করতে পারি না। এক পোলার ৮ হাজার টাকা বেতনে ঘর ভাড়া, খাওয়া চলে না। হের লাইগ্যা ১ তারিখ (অক্টোবর) বাড়িত যামুগা। পোলারে নিয়ে গেরামে যদি কোনো কামে কাজে দেওন যায়।’
স্বামী হত্যার বিচার চাওয়ার বিষয়ে আসমা বলেন, ‘বিচার আল্লাহর কাছেই রাখছি। গরিব মানুষের বিচার আছে? গরিব মানুষ, কী বিচার চামু, আল্লায় যদি বিচার করে। আল্লাহ ছাড়া দুনিয়াতে আর কিছু নাই।’
বৃদ্ধ মামা ও মায়ের দেখাশোনা করতেন সেলিম সেক। ছেলে মৃত্যুর পর বাবা কলিম উদ্দিন সেক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘তকদিরে আছে আমার আগে পুত মইর্যা যাইব। ফিরানির ক্ষ্যামতা নাই। বিচার আল্লার কাছে দিয়া থুইছি। যারা আমার পুতেরে মারছে তারার বিচার আল্লাহই করব।’
মা সখিনা বেগম বলেন, ‘আন্দোলন দেখবার গিয়া আমার পুত গুলি খাইয়া মরছে। একটা গুলি শইল্যোর একখান দিয়া লাইগ্যা আরেক খান দিয়া বাইরইছে। আমরা মামলা কইর্যা কি করবাম। মামলা করলে কি পোলারে পাইয়াম। আমরা গরিব মানুষ, মামলা চালাইবার পারতাম না।’