রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কেনাকাটায় অনিয়ম, অপচয় ৯৮ লাখ টাকা
বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ভোক্তা বিভাগে প্রয়োজনীয় চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত ১০ হাজার ২৪৭টি মালামাল কিনে টাকা অপচয় করা হয়েছে।
চাহিদা অনুযায়ী ছয় ধরনের ৪ হাজার ৫০৫টি মাল কেনায় ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ৩১ লাখ ৫১ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ১৪ হাজার ৭৫২টি মালামাল কিনে মোট ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৯০ হাজার ৩৩৬ টাকা। সে হিসাবে অপচয় করা হয়েছে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা।
সম্প্রতি রেলওয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মো. নূরুল ইসলামের স্বাক্ষর রয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কেনাকাটাসহ বিভিন্ন খাতের অনিয়মের চিত্রও উঠে এসেছে। কেনাকাটার অনেক ভুয়া ভাউচারও জমা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেকর্ড ১৮ এল (প্লাস্টিকের পাইপ খোলার রেঞ্জ) চাহিদা অনুযায়ী কেনার প্রয়োজন ছিল পাঁচটি। প্রতিটির দাম ২ হাজার ২৬৬ টাকা। এটা কেনা হয়েছে ১ হাজার ১০০টি। ছাড়ের পর মূল্য দাঁড়ায় ২৪ লাখ ৮১ হাজার ২৭০ টাকা। কাভারিং বক্সের চাহিদা ছিল ১০টি। প্রতিটির মূল্য ১১ হাজার ২৪০ টাকা। কেনা হয়েছে ২২২টি। ব্যয় হয়েছে ২৩ লাখ ৮২ হাজার ৮৮০ টাকা। এলবো-১৮ এল (পানির পাইপ বাঁকা করার এল আকৃতির যন্ত্র) প্রতিটির দাম ৪ হাজার ৫৪২ টাকা। ১০০টি কেনার কথা থাকলেও কেনা হয়েছে ৫৫০টি। এতে ব্যয় হয়েছে ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ টাকা।
ট্র্যাকশন সেন্টার ইলাস্টিক যন্ত্র চাহিদা অনুযায়ী কেনার কথা ৫০টি। কেনা হয়েছে ২০০টি। প্রতিটির মূল্য ১২ হাজার ৪৯৭ টাকা। এতে ব্যয় হয়েছে ১৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৫০ টাকা। ভেস্টিবুল ফল প্লেট কেনার কথা ছিল ৫০টি। কেনা হয়েছে ১৮০টি। প্রতিটির মূল্য ১৩ হাজার ৮৭৭ টাকা। ব্যয় হয়েছে ১৮ লাখ ৪ হাজার ১০ টাকা। ড্রিল টুইস্ট (ড্রিল মেশিনের সামনের অংশ, যেটা দেয়ালের মধ্যে ঢোকে)-এর চাহিদা ছিল ৪ হাজার ২৯০টি। কেনা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০টি। প্রতিটির মূল্য ২৮০ টাকা ৬০ পয়সা। ব্যয় হয়েছে ২৩ লাখ ৩ হাজার ৭২৬ টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাহিদার চেয়ে গড়ে তিন গুণের বেশি মালামাল ক্রয় করে অনিয়ম ও অর্থ অপচয় করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় চাহিদার চেয়ে ১০ হাজার ২৪৭টি অতিরিক্ত মালামাল কেনা হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী ছয় ধরনের ৪ হাজার ৫০৫টি সামগ্রী কিনলে ব্যয় হতো ৩১ লাখ ৫১ টাকা। বাস্তবে চাহিদার চেয়ে বেশি মালামাল কিনে ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৯০ হাজার ৩৩৬ টাকা। সে হিসাবে ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ২৮৫ টাকা বাড়তি অপচয় করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মামুনুল ইসলাম বলেন, এসব ২০২০-২১ সালের করোনাকালের প্রতিবেদন। অবশ্য তিনি এখনো দেখতে পারেননি। তারপরও এই প্রতিবেদন নিয়ে তাঁদের ত্রিপক্ষীয় একটি বৈঠক হবে। সেখানে যদি কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তিযোগ্য হয়, সেগুলো নিষ্পত্তি হবে। আর যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ছাড়া রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহীর ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলীর (বিদ্যুৎ) কার্যালয়ের ইলেকট্রনিক ব্যালাস্ট কেনার ক্ষেত্রে অনিয়ম ধরা পড়েছে। সেখানে ৩০০টি ১৮ ওয়াটের ইলেকট্রনিক ব্যালাস্ট কেনার ভাউচার দেখানো হয়েছে ৪৪ হাজার ১০০ টাকা। বাস্তবে ১৪ ওয়াটের ব্যালাস্ট পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়েছে, ভোক্তা বিভাগ তথা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক পশ্চিম কার্যালয়ে পাঁচ সেট সপ্তম জেনারেশনের কম্পিউটার কেনার বিষয়টির উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি।
কেনাকাটার কাগজপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া ভাউচারগুলোতে একটি সামগ্রীর কথা উল্লেখ আছে, কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেছে অন্য সামগ্রী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনোটি পাওয়াই যায়নি। নিরীক্ষায় এ ধরনের ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৬০০ টাকার ভুয়া ভাউচার মিলেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজশাহীতে প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে দুটি ৪৩ ইঞ্চি এলইডি স্মার্ট টিভি (সনি) কেনার জন্য ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮০ টাকার ভাউচার দেখানো হয়েছে। বাস্তবে গিয়ে ওই কার্যালয়ে এই টিভি পাওয়া যায়নি। সেখানে একটি ৪০ ইঞ্চি ও একটি ৩২ ইঞ্চি সনি টিভি পাওয়া গেছে। স্টক রেজিস্ট্রার দেখাতে বলা হলেও তারা দেখাতে পারেনি। স্যামসাং কোম্পানির একটি মাইক্রোওভেন কেনা দেখানো হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৯০ টাকায়। বাস্তবে সিঙ্গারের একটি মাইক্রোওভেন পাওয়া গেছে। তা আগের কেনা কি না, স্টক রেজিস্ট্রার না থাকায় যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ৪ হাজার ৯৯০ টাকায় একটি ইলেকট্রিক ইনডাকশন (চুলা) ও ১ লাখ ৪৯ হাজার ৯০০ টাকার একটি আইপিএস মেশিন কেনার ভাউচার দেখানো হলেও বাস্তবে দুটি জিনিসের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।
পশ্চিম রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তার কার্যালয়ের গাড়ির টায়ার, টিউব ও ব্যাটারি কেনার ক্ষেত্রেও ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করা হয়েছে। ১ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা দেখানো হলেও মজুতে পাঁচটি নতুন টায়ার, পাঁচটি নতুন টিউব ও একটি ব্যাটারি পাওয়া যায়নি। নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়েছে, না পাওয়া পাঁচটি টায়ার ও টিউব অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, সেগুলো টিউবলেস টায়ার, যা অনেক পুরোনো।
টিকিটপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি না করে যাত্রীপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি করায় সরকারের ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৬৬৫ টাকা অতিরিক্ত কমিশন দিতে হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কম্পিউটারাইজড সিট রিজারভেশন অ্যান্ড টিকিটিং সিস্টেমের (সিএসআরটিএস) জন্য প্রয়োজনীয় সব হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, অ্যাকসেসরিজসহ আনুষঙ্গিক সেবা সরবরাহের চুক্তির মূল্য নির্ধারণ করা হয় যাত্রীপ্রতি ২ টাকা ৯৯ পয়সা। টিকিটপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি না করে যাত্রীপ্রতি কমিশন দেওয়ার চুক্তি করায় একের অধিক ব্যক্তির ওপরে পৃথকভাবে কমিশন দিতে হয়। এতে সরকারের অতিরিক্ত আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।