ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে যা জানালেন বেঁচে যাওয়া ঝিনাইদহের যাত্রী আক্তারুজ্জামান
‘শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিকট শব্দ পেয়ে বুঝলাম সামনে কিছু একটা ঘটেছে। চেয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না। শুধু কানে ভেসে এল চিৎকার-চেঁচামেচি। পেছনের কামরা থেকে নেমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সেটাও সম্ভব হলো না। আমাদের সরিয়ে নেওয়া হলো, ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হলো না। সরানোর সময় চোখে পড়ল নিহত-আহত ব্যক্তিদের নিয়ে ছোটাছুটি। বুঝলাম ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। হতাহত ব্যক্তিদের দেখে প্রচণ্ড ভয় পেলাম, বুঝে নিলাম বড় দুর্ঘটনা থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি।’
ভারতের ওডিশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সামন্তা এলাকার মো. আক্তারুজ্জামান। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুর্ঘটনাকবলিত করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। আক্তারুজ্জামান মহেশপুর সরকারি পদ্মপুকুর শেখ হাসিনা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান একজন গৃহিণী। চিকিৎসার জন্য তাঁরা করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলরে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পর আজ শনিবার সকাল ৭টায় তাঁদের অপর একটি ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ভেলরের পথে রয়েছেন। এই ট্রেনে আরও অনেক বাংলাদেশি যাত্রী ছিলেন বলে জানিয়েছেন এই দম্পতি।
ভারতের ওডিশা রাজ্যের বালাসোরে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ২৮৮ জনের প্রাণ গেছে বলে জানিয়েছেন ওডিশা ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক সুধাংশু সারেঙ্গি। তিনি আরও জানান, আহত ৮৫০ জনের বেশি। অনেকেই ট্রেনের ভেতরে আটকা পড়েছেন। উদ্ধারকাজ এখনো চলছে। তাই হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
আজ শনিবার মুঠোফোনে কথা হয় মো. আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, স্ত্রী নুরজাহানের চোখের সমস্যা। বেশ কয়েক দফা ভারতে চিকিৎসা করিয়েছেন। এবার সিদ্ধান্ত নেন ভেলর গিয়ে চিকিৎসা করাবেন। সে জন্য ১ জুন ভারত যান। এরপর ট্রেনের টিকিট নিয়ে গতকাল শুক্রবার দুপুরে হাওড়ার শালিমার স্টেশনে হাজির হন। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে তাদের নির্ধারিত করমন্ডল ট্রেনটি স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা যখন ওডিশার বালাসোর জেলার বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় পৌঁছান তখন ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে। তারা বিকট শব্দ ও ঝাঁকুনি অনুভব করেন। ট্রেনের মধ্যে থাকা হাজার হাজার মানুষ কান্নাকাটি শুরু করেন। তারাঁও বুঝে নেন ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়েছে।
আক্তারুজ্জামান জানান, তাঁরা ছিলেন ২-এ এসি বগিতে। তাঁদের সামনে ছিল আরও কয়েকটি বগি। তাঁরা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে সামনে কী ঘটেছে, দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেখানে উপস্থিত স্থানীয় মানুষগুলো তাঁদের যেতে দিল না। তাঁরা উদ্ধারকাজ শুরু করে দিলেন। আর যাঁরা ভালো আছেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হলো। এরপর বাসযোগে কিছুটা দূরে এক এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেন। সেখান থেকে আজ সকালে ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে আরেকটি ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন ভেলরের পথে।
আক্তারুজ্জামান বলেন, ঘটনার পর তাঁরা ছিলেন অন্ধকারের মধ্যে। কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ঘটনাস্থল থেকে বাসে ওঠা পর্যন্ত সময়টুকু তাঁদের আতঙ্কে কেটেছে। তবে যখন তাঁদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, তখন দেখতে পান হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে ছোটাছুটি, যা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। আহত মানুষের চিৎকার কষ্ট দিয়েছে। শুধু ভেবেছেন এত বড় এক দুর্ঘটনায় পড়েও তাঁরা ভালো আছেন! কী হচ্ছে সামনে তা তাঁরা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। অনেক বাংলাদেশি ছিল এই ট্রেনে। তাঁরা কেমন আছেন, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না।
মুঠোফোনে আক্তারুজ্জামানের স্ত্রী নূরজাহান বলেন, তাঁরা যে কামরায় ছিলেন সেখানে দুজন বাংলাদেশি ছিল। তবে অন্য কামরাগুলোয় আরও অনেক বাংলাদেশি ছিল। পরের ট্রেনে তাঁদের তুলে দেওয়ার পর বুঝতে পেরেছেন অনেক বাংলাদেশি দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে ছিল। তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন তথ্য তাঁরা পাননি। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে তাঁরা ভালো আছেন, যাঁরা চিকিৎসার জন্য ভারতে আছেন, তাঁদের সবার জন্য তিনি দোয়া চেয়েছেন।
মহেশপুরের সামন্তা এলাকার বাসিন্দা বাদশা মিয়া বলেন, ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর শুনে আক্তারুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এলাকার মানুষ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। পরে তাঁদের ভালো থাকার খবরে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।