‘তুই কোনটে নুকালু, মুই কেমন করি চলাইম’

নিহত জিকরুল হকের স্বজনদের আহাজারি। রোববার দুপুরে বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের আমরুলবাড়ি পলিপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

স্বামীহারা বুলবুলি বেগমের (৩৮) চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। কখনো চুপচাপ মাথা নিচু করে আবার কখনো মানুষের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকছেন। নীরবতা ভেঙে হঠাৎ আহাজারি করছেন আর বলছেন, ‘আহারে সংসারটা তছনছ হয়া গেল মোর। মোক থুইয়া তুই একলায় কোনটে নুকালু (লুকানো)। মুই এ্যালা (এখন) কেমন করি সংসারটা চলাইম। মোর জেবনটা অন্ধকার হয়া গেল।’

নিখোঁজের পাঁচ দিন পর গতকাল শনিবার দুপুরে বুলবুলি বেগমের স্বামী জিকরুল হকের (৪২) গলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটি বাঁশঝাড় থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর পর থেকে বুলবুলি বেগমের কান্না থামছে না। নিহত জিকরুলের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের আমরুলবাড়ি পলিপাড়া গ্রামে।

বদরগঞ্জ-লালদীঘি পাকা সড়ক ধরে বটতলী এলাকার পশ্চিম দিকে একটি কাঁচা সড়ক চলে গেছে। সড়ক পেরিয়ে নিভৃত গ্রামে জিকরুলের বাড়ি। আজ রোববার দুপুরে গ্রামে ঢুকতেই এলাকাবাসী জিকরুলের আধা পাকা টিনশেডের বাড়ি দেখিয়ে দেন। দরজায় পা রাখতেই ভেতর থেকে আহাজারির শব্দ পাওয়া গেল। জানা গেল, নিহত জিকরুলের স্ত্রী ঘরের ভেতরে কাঁদছেন। এরপর একে একে বাড়িতে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। সবার মনে প্রশ্ন, সাদাসিধে জিকরুলকে হত্যা করল কে?

প্রতিবেশী জমিলা বেগম বলেন, জিকরুল ভালো মানুষ ছিলেন। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত। রিকশাভ্যান চালানোর পাশাপাশি বাড়িতে গরু পালতেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন। এমন মানুষের শত্রু থাকার কথা নয়। তাঁকে কারা, কেন মারল? তাঁরা প্রতিবেশীরা হিসাব মেলাতে পারছেন না।

প্রতিবেশীদের কথা শুনতে শুনতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন জিকরুলের বড় ভাই মঞ্জুরুল ইসলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশকে বলেছি, আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু নাই। পুলিশ বলছে, জঙ্গলে লাশের ১৫-১৬ ফুট দূরে দুইটা বিষের খালি বোতল পাওয়া গেছে। ওই বোতল তো খেতে স্প্রে করেও কেউ ফেলতে পারে। আমার ভাই আত্মহত্যা করলে গহিন জঙ্গলে গিয়ে করবে কেন? বাড়িতে কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়াও হয়নি। আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

জিকরুলের স্ত্রী বুলবুলি বেগম বলেন, ‘মোর স্বামীর কোনো শত্রু আছিল না। হামরা কখনো কারও ক্ষতি করি নাই। নিজ মনে কামাই করি খাইতাম। এলাকাত শুনি দেখেন, কত ভালো মনের হাসিখুশি মানুষ আছিল মোর স্বামী। কখনো হামাক (আমাদের) কষ্ট বুজবার দেয় নাই।’ এরপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি।

প্রতিবেশীরা জানান, নিহত জিকরুলের আধা পাকা টিনশেডের তিন কক্ষের বাড়িটি তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁর প্রয়াত বাবা মজমুল হক। পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন চার শতক বসতভিটা। পরে রিকশাভ্যান চালিয়ে ও গরু পালনের উপার্জিত টাকা জমিয়ে জিকরুল তিন লাখ টাকায় ১৮ কাঠা জমি বন্ধক নিয়েছিলেন। এই জমিতে ধান চাষ করে তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসার চলত।

বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু হাসান কবির বলেন, জিকরুল হক ৮ জুলাই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর গতকাল বদরগঞ্জ-লালদীঘি সড়কের চম্পাতলীর অদূরে বাঁশঝাড় থেকে তাঁর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের অন্তত ১৫ ফুট দূরে কীটনাশকের দুটি খালি বোতল পড়েছিল। তিনি বলেন, ঘটনাটি রহস্যজনক। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। এ ঘটনায় আপাতত থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।