১৪ বছর ধরে শুধু দখলদার বদল হতে দেখছেন অসহায় ভূমিমালিকেরা

সাড়ে তিন শ বিঘা জমির ওপর খালটির নাম ‘সরোয়ারখালি খাল’। ১২ অক্টোবর কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সরোয়ারখালি খালের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ২০০৯ সালে ভেঙে যায় বেড়িবাঁধ। নদীর লোনাপানি ওঠানামা করায় ফসলি জমিতে তৈরি হয় খাল। এতে শতাধিক কৃষক জমিয়ে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। শ্রেণি পরিবর্তন হওয়া জমিতে অধিকার হারান তাঁরা। দুই বছর পর বাঁধ মেরামত শেষ হয়। শুরু হয় খাল নিয়ে দখলদারত্বের পালাবদল। ১৪ বছরে সাড়ে তিন শ বিঘা জমির ওই খালে পাঁচবার দখলদার পরিবর্তন হয়েছে। অথচ জমির মালিক হয়েও বঞ্চিত হয়েছেন কৃষকেরা।

এমন পরিস্থিতি খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সরোয়ারখালি খাল নিয়ে। বর্তমানে খুলনার একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে সব দখলদার হটিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে খালটি।

সম্প্রতি সরেজমিনে জানা যায়, খালে ফসলি জমি হারিয়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শতাধিক কৃষক। এ রকমই একজন হলুদবুনিয়া গ্রামের আবদুল গনি গাজী। পৈতৃক আট বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে তিন ভাইয়ের দিন চলত ভালোই। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আইলা দুর্দিনে ফেলেছে তাঁদের। এখন দিনমজুরি করে অনেককে সংসার চালাতে হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা হারুনর রশীদ বলেন, খালে তাঁদের পারিবারিক ৪০ বিঘা জমি আছে। প্রথমে দুই বছর ইজারার টাকা পেয়েছেন। পরে আর টাকা পাননি। দখলদারের চোখ রাঙানির ভয়ে জমির পাশেও যেতে পারেননি তাঁরা। এখন তাঁর এক ভাই ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করে যা টাকা পাঠান এবং নিজের দিনমজুরিতে আট সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

এমন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে ১৫২ জন কৃষক দিন পার করছেন বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মোজাফফর হোসেন। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীর পানিতে তলিয়ে যায় এলাকার ফসলি জমি। কয়েক বছর ধরে নদীর পানি ওঠানামার কারণে ফসলি জমি ভেঙে এলাকার অনেক স্থান খালে পরিণত হয়। এমনই একটি খাল সরোয়ারখালি। খালটির এক মাথায় সরোয়ার আলী নামের এক ব্যক্তির বাড়ি ছিল। পানির চাপে প্রথমে ওই ব্যক্তির বসতবাড়ি ভেঙে যায় এবং দুই পাশের ফসলি জমি ভেঙে উৎপত্তি হয় বড় খালের। সেই থেকে এলাকাবাসীর কাছে সরোয়ারখালি খাল হিসেবে পরিচিতি পায়।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সরোয়ারখালি খালের জমির মালিক ও খালসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় আড়াই বছর পতিত অবস্থায় থাকার পর জমিমালিকদের সবার সম্মতিতে হাবিবুর রহমান নামে সাতক্ষীরার এক চিংড়ি চাষির কাছে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। প্রতি বিঘা জমি চার হাজার টাকা হিসেবে দুই বছর ভালোভাবে পেয়েছিলেন তাঁরা। পরে প্রশান্ত মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি ঘেরের নিয়ন্ত্রণ নিলে জমির মালিকেরা ইজারার টাকা থেকে বঞ্চিত হন। এতে জমির মালিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন সংসদ সদস্য নুরুল হকের কাছে অভিযোগ করলে, তিনি নিজেই (নুরুল হক) খালটি ইজারা নেন। এরপর কিছু জমির মালিক বিঘাপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে পেলেও অনেকেই বঞ্চিত হন। দুই বছর না যেতেই নুরুল হককে হটিয়ে খাল দখলে নেন কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মোহসীন রেজা ও সাধারণ সম্পাদক বিজয় সরদার। তাঁরা দেড় বছরের মতো খালের নিয়ন্ত্রণ রাখেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও জানান, একপর্যায়ে প্রাণ গোপাল নামের এক ব্যক্তির কাছে ১০ বছরের জন্য ইজারা দেন জমির মালিকেরা। প্রাণ গোপাল কিছুদিন পর হরিপদ মণ্ডলকে খালের দায়িত্ব দিলে সেখানে বহিরাগত দুর্বৃত্তদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য পাওনা (ইজারার টাকা) থেকে বঞ্চিত করা হয় জমির মালিকদের। দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে কিছুদিন আগে স্থানীয় নিতাই মণ্ডল ও দেবাশীষ মণ্ডল নামের দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে খুলনার একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কাছে যান জমির মালিকেরা। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত হয়, বহিরাগত কাউকে ওই খাল ইজারা দেওয়া যাবে না। জমির মালিকদের মধ্যে যে কেউ দায়িত্ব নিয়ে সেখানে মাছের চাষ করবেন এবং জমির মালিক সবাই লাভের টাকার অংশীদার হবেন। সিদ্ধান্ত মেনে এলাকায় ফিরলে দেবাশীষ ও নিতাই মণ্ডলের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। একসময় সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জিম্মায় দেওয়া হয় খাল।

নিতাই মণ্ডল বলেন, ‘খুলনা শহর থেকে ফিরে খালের সব জমিমালিককে নিয়ে বসি, বেশির ভাগ জমিমালিক আমাকে দায়িত্ব নিতে বলেন। এর মধ্যে দেবাশীষ অল্প কিছুসংখ্যক জমিমালিককে নিয়ে খাল দখলে নেওয়ার চেষ্টা করলে দ্বন্দ্ব বেধে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সহায়তা চাইলে খালটি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।’

দেবাশীষ মণ্ডল বলেন, দীর্ঘদিন বহিরাগত দখলদারের কাছে জিম্মি ছিলেন খালের জমি মালিকেরা। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অবশেষে জমিমালিকেরা তাঁদের ন্যায্য পাওনা বুঝে পাওয়ার একটি পথ পেয়েছেন। কিন্তু খালসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা হয়েও নিতাই মণ্ডল এত দিন বহিরাগত ব্যক্তিদের হয়ে কাজ করতেন। এখন তিনি সাধারণ জমিমালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের নামে জমি ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

ইউপি চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল বলেন, দীর্ঘদিন পর বহিরাগত ব্যক্তিদের হাত থেকে খালটি দখলমুক্ত হওয়ার পর জমিমালিকেরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আপাতত খালটি ইউনিয়ন পরিষদের জিম্মায় আছে।

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে বহিরাগত কোনো দখলদার সেখানে নেই। জমিমালিকেরা যাতে তাঁদের ন্যায্য অধিকার বুঝে পান, সে জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্যদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান করা হবে।