গ্রামের স্কুল থেকে তাঁরা এখন জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়
সানজিদা, শারমিন, রুপিয়া, রাশিদা—নাম ভিন্ন হলেও পরিচয়টা অভিন্ন। তাঁরা খেলোয়াড়। অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম, খেলছেন জাতীয় পর্যায়ে। কেউ হকি, কেউ রাগবি, কেউবা বাস্কেটবল, আর্চারিতেও আছে কারও কারও নাম। তাঁরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। একই স্কুলে পড়েছেন।
খেলাধুলায় তাঁদের আগ্রহ, অধ্যবসায় সর্বোপরি এমন সাফল্যের পেছনে আছেন একজন শিক্ষক। যাঁর অনুপ্রেরণায় তাঁরা খেলাধুলায় এসেছেন। যিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তাঁদের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে মেয়েদের মাঠে নিয়ে আসতে যে শিক্ষক অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন, তিনি মাসুদ রানা (৫১); ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের শরীরচর্চার শিক্ষক।
স্কুলটি ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সালন্দর গ্রামে। এই বিদ্যালয়ের কমপক্ষে ১২ ছাত্রী জেলার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় অবদান রেখে চলেছেন। কেউ কেউ পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
খালি পায়ে অনুশীলন
সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে ছেলেরা খেলত। আর মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেদের খেলা দেখত। শরীরচর্চার শিক্ষক মাসুদ রানা ভাবতেন, মেয়েরাও তো খেলতে পারে। কিন্তু মেয়ে খেলোয়াড় জোগাড় করা সহজ ছিল না। সামাজিক রীতিনীতি ও নানা কুসংস্কারের কারণে অনেক অভিভাবক মেয়েদের খেলতে দিতে চাইতেন না। মাসুদ রানা মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝালেন। কিন্তু অভিভাবকেরা বাড়ির মেয়েদের মাঠে খেলতে দিতে রাজি নন। তবে মাসুদ রানা নাছোড়। অনেক চেষ্টার পর, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধ–উপরোধের পর কয়েকজন অভিভাবক মেয়েদের খেলতে দিতে রাজি হলেন।
সে ২০১৪ সালের কথা। সেই থেকে শুরু। সেবারই স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে হকি ও বাস্কেটবল দল গঠন করেন মাসুদ রানা। দল গঠন হলেও খেলাধুলার তেমন কোনো সামগ্রী ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মেয়েদের পক্ষে জুতা-জার্সিসহ ক্রীড়াসামগ্রীর টাকা জোগান দেওয়াও ছিল কঠিন। তাই সাধারণ পোশাক আর খালি পায়েই মেয়েদের অনুশীলন চালাতে লাগলেন মাসুদ রানা। মাঠের খড়কুটা আর আবর্জনায় পা কেটে রক্ত ঝরে, তবু মেয়েরা দমেনি।
হকি খেলোয়াড় মোকছেদা আক্তার বলেন, ‘তখন কেবল হকি খেলা শুরু করেছি আমরা। সব খেলোয়াড়ের হকিস্টিকও ছিল না।’
আছে দুই শতাধিক ট্রফি
২০১৫ সালে এসে বিদ্যালয়ের হকি দলটা দাঁড়িয়ে যায়। সে বছর জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার হকি খেলায় অংশ নেয় সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা। জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয় তারা। এরপরই বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের খেলার প্রতি আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যায়। ২০১৭, ২০১৮ সালেও জাতীয় পর্যায়ে মেয়েরা রানার্সআপ হয়। ২০২০ ও ২০২২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা।
এই স্কুলের মেয়েরা জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বাস্কেটবলে একবার চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ হয় তিনবার। ২০১৮ ও ২০২১ সালে যুব গেমসে সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে গড়া ঠাকুরগাঁও বাস্কেটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়।
সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা জাতীয় মহিলা রাগবিতে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়। আর সর্বশেষ যুব গেমসে ব্রোঞ্জপদক পায়। ব্যক্তি ও দলীয় পর্যায়ে সব মিলিয়ে দুই শতাধিক ট্রফি এখন বিদ্যালয়ের ঝুলিতে।
সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েদের অর্জনের কথা শুনেছেন বলে জানালেন ঠাকুরগাঁও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এসব মেয়ে নানা সংকটের মধ্যেও খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশের। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
একজন মাসুদ রানা
ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড় মাঠ ঘিরে চলত ক্রীড়াঙ্গনের নানা আয়োজন। ওই মাঠের পাশেই মাসুদ রানার বাড়ি। ছোটবেলা থেকে মাঠ আর খেলা ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। খেলতেন ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবলসহ নানা খেলা। ১৯৯৩ সালে স্নাতক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহীর শারীরিক শিক্ষা কলেজে। সেখান থেকে ফিরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার একটি মাদ্রাসায় ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। সে চাকরি ছেড়ে ২০১৪ সালে যোগ দেন সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ে।
খেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করে অনূর্ধ্ব–২১ হকি নারী দলের সুযোগ পেয়েছেন ৬ জন। তাঁরা হলেন সানজিদা আক্তার (সাথী), রানী আক্তার, মোকছেদা আক্তার, তাসমিম আক্তার, জাকিয়া আফরোজ ও সিমু আক্তার। জাতীয় নারী বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় শারমিন আক্তার ও মুসলিমা আক্তার। রাগবির জাতীয় নারী দলে আছেন রুপিয়া আক্তার ও রুবিনা আক্তার। রোলবলের (রোলার স্কেটিং, বাস্কেট বল ও হ্যান্ডবলের সমন্বয়ে একটি খেলা) জাতীয় নারী দলে আছেন সানজিদা আক্তার (পলি) এবং আর্চারির জাতীয় নারী দলে রয়েছেন মনি আক্তার। খো খোর জাতীয় নারী দলে রাশিদা আক্তার ও লামিয়া আক্তার খেলছেন।
খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে ছাত্রীদের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। রাশিদা আক্তার জাতীয় খো খো দলের খেলোয়াড়। খেলোয়াড় কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। তিনি এখন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়ছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে। রাশিদা বললেন, ‘মানুষের কটুকথা উপেক্ষা করে খেলাধুলার মধ্যে ছিলাম বলেই আজ আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছি।’
আছে চ্যালেঞ্জও
বিদ্যালয়ে খেলার সরঞ্জামের সংকট আছে। বিদ্যালয়ে নেই কোনো বাস্কেটবল কোর্ট। অনুশীলনের জন্য সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মেয়েদের আসতে হয় জেলা শহরে। প্রান্তিক পরিবারের সদস্য হওয়ায় খেলাধুলার জন্য যে ধরনের পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন, তা পায় না এই মেয়েরা। খেলার জন্য একজোড়া ভালো বুটও নেই তাদের অনেকের।
মাসুদ রানা বললেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ের মেয়েদের মধ্যেও প্রতিভা রয়েছে। আমি তাদের প্রতিভাকে শাণ দিয়ে যাচ্ছি মাত্র। অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি নারী খেলোয়াড়দের দেশের বিভিন্ন বাহিনীতে খেলোয়াড় কোটায় চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে মেয়েদের এ সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে পারতেন।’
সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল আলম বলেন, মেয়েদের খেলাধুলা চালিয়ে নিতে অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে আরও প্রতিভাবান খেলোয়াড় জোগান দিতে পারবেন।