শাজাহানপুরে গ্রামীণ জনপদে আতঙ্কের নাম ‘সাগর বাহিনী’
গোলাম মোস্তফা তালুকদারের নাম পুলিশের খাতায় আছে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে। মাদকের মামলায় দফায় দফায় জেল খাটার পরও তিনি গড়ে তুলেছেন অর্থবিত্ত। তাঁকে অনুসরণ করেছেন তাঁর ছেলে সাগর হোসেন তালুকদার (৩৩)। খুন, হত্যা, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, অস্ত্রবাজিসহ মোটামুটি সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে সাগর হয়ে উঠেছেন বগুড়ার শাজাহানপুর, কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী সাবরুল বাজার এলাকার অপরাধ জগতের ‘ডন’।
পুলিশের হিসাবে, সাগর তালুকদার দুটি হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ এক ডজন মামলার আসামি। নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেন না। স্থানীয় ২৫-৩০ তরুণ-যুবককে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘সাগর বাহিনী’। প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে রীতিমতো ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’ হয়ে উঠেছে এই বাহিনী।
২ সেপ্টেম্বর সকালে শাজাহানপুর উপজেলার মাথাইলচাপড় এলাকায় কলেজশিক্ষক ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহজালাল তালুকদার ওরফে পারভেজকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাগর বাহিনীর কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছেন নিহত শাহজালালের স্ত্রী সামছুন নাহার।
সাবরুল বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বাজারে প্রকাশ্যে দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাগর তালুকদার জড়িয়েছেন। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে নিজেকে সংগঠনের কর্মী পরিচয় দেন। কলেজশিক্ষক শাহজালাল হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে একটি মামলায় স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান সাগর। তাঁর বাবা গোলাম মোস্তফাও মাদকের একটি মামলায় এখন কারাগারে।
নিহত শাহজালালের স্বজনদের অভিযোগ, সাগরের বিরুদ্ধে বিচারাধীন একটি হত্যা মামলায় শাহজালাল তালুকদারের ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার সাক্ষী হওয়ায় তাঁদের পুরো পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সাগর। এ কারণে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে বসে হত্যার ছক আঁকেন তিনি। মাস দেড়েক আগে নুরুজ্জামানকেও ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা করেন তিনি। তখন শাহজালালকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। কারাগার থেকে তাঁর দেওয়া নির্দেশের পরই শাহজালালকে কুপিয়ে হত্যা করেন সাগর বাহিনীর সদস্যরা।
মামলার বাদী শাহজালালের স্ত্রী সামছুন নাহার চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাসখানেক আগে সন্ত্রাসী সাগর হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন শাহজালালকে। জেলে থেকে ছক কষে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি।
সাগর বাহিনীর দাপটে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নাম ভাঙিয়ে শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম ও কাহালু উপজেলার আশপাশে ৩০ গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন সাগর তালুকদার। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিতে সিদ্ধহস্ত তিনি। শাজাহানপুর উপজেলার সাবরুল বাজারের সাগরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মামা-ভাগনে এন্টারপ্রাইজ কার্যত সন্ত্রাসীদের আখড়া। এক দশক ধরে ওই দোকানে বসে নানা অপকর্মে জড়িয়েছেন তিনি। তাঁর ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি এলাকাবাসী।
বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, বাড়ি নির্মাণ, জমি কেনা থেকে ব্যবসা সবকিছুতেই চাঁদা দিতে হতো সাগরকে। তাঁর ২৫-৩০ জনের একটি বাহিনী আছে। মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে সবাই চলাফেরা করেন। সড়কে মাছের গাড়ি, যানবাহন থেকে শুরু করে জমি চাষের পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর থেকেও চাঁদাবাজি করেন তাঁরা।
খুন হয়, বিচার হয় না
২০২১ সালের ৩০ মে সাবরুল বাজারে মাছের আড়তে চাঁদাবাজির জেরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শিহাব উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করেন সাগর বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনায় শিহাবের স্ত্রী রুমি খাতুন শাজাহানপুর থানায় সাগরকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে সাগরসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
মামলার বাদী ও নিহত শিহাবের স্ত্রী রুমি খাতুন বলেন, মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। সাগরের ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে সাহস পাচ্ছেন না।
সাবরুল বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শিহাব উদ্দিনকে হত্যার সময় সাবরুল বাজার কমিটির সভাপতি ছিলেন নুরুজ্জামান তালুকদার। মামলাটিতে তাঁকে সাক্ষী করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এ বছরের ২৩ জুলাই নুরুজ্জামানকে অপহরণ করে ছুরিকাঘাত করেন সাগর। এ সময় সাগর হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তোর ছোট ভাই পারভেজকে (শাহজালাল) কেটে টুকরা টুকরা করে মেরে ফেলব।’ এর দেড় মাসের মাথায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শাহজালাল পারভেজ।
এর আগে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়নের মাথাইলচাপড় পশ্চিমপাড়ায় আবু বকর সিদ্দিক (২৮) নামে এক প্রবাসীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে ঘটনায়ও নেপথ্যে সাগর ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
সম্প্রতি নিহত কলেজশিক্ষক শাহজালালের সঙ্গে ব্যবসা করতেন তাঁর মামা আবদুল আজিজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চার বছরে সাবরুল বাজার এলাকায় শিহাব উদ্দিন, আবু বক্কর ও মজনু নামে তিনজনকে দিনের আলোয় হত্যা করা হয়েছে। শেষ তাঁর ভাগনে শাহজালালকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সব কটি হত্যার নেপথ্যেই ছিলেন সাগর তালুকদার। একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটালেও কোনো বিচার হয় না। পুলিশও ব্যবস্থা নেয় না।
জানতে চাইলে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, সাগরের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা ছাড়া চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনে ১২টি মামলা আছে। সম্প্রতি একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করে তিনি কারাগারে আছেন। কারাগারে থেকেই কলেজশিক্ষক শাহজালালকে হত্যার ছক এঁকেছেন বলে পুলিশি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সাগরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাঁকেও মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।