১৪২ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বনবিবির পূজা ও মেলা’

অরণ্যের দেবী হিসেবে প্রতিবছর মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বনবিবির পূজা ও মেলাছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনায় প্রথমেই যাঁর কথা উল্লেখ করতে হয়, তিনি বনবিবি। সুন্দরবন উপকূলের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, বনবিবি সুন্দরবনে যত্রতত্র যাতায়াত করেন। বাঘ, কুমিরসহ সব হিংস্র জন্তু তাঁর অনুগত। তাই অরণ্যের দেবী হিসেবে প্রতিবছর মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বনবিবির পূজা ও মেলা।

প্রতিবছরের মতোও এবারও গতকাল মঙ্গলবার ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ পূজা ও মেলা। ১৪২ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় যোগ দিতে হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।

গতকাল মঙ্গলবার কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন চরামুখা, ঘড়িলাল, ১ নম্বর কয়রাসহ সুন্দরবনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামবাসীরা মণ্ডপ তৈরি করে সেখানে পূজার জন্য বনবিবি, শাহ জঙ্গলি, ধনা, মনা, গাজী কালু, দুঃখে ও দক্ষিণ রায়ের (সুন্দরবনের বাঘের মূর্তি) তৈরি করে রেখেছেন। দিনভর পুঁথিপাঠের মধ্য দিয়ে বনবিবিকে স্মরণ, প্রসাদ বিতরণসহ নানা কর্মকাণ্ড চলে। আর রাতে শুরু হয় মেলা। নানা পণ্য নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে মেলায় আসেন দোকানিরা।

সুন্দরবনসংলগ্ন ঘড়িলাল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘড়িলাল বাজারের কাছেই বিলের মধ্যে তৈরি হয়েছে মেলার মঞ্চ। চারদিকে বসেছে পণ্যের পসরা। শিশুদের হইহুল্লোড়ে মাতোয়ারা খেলনার দোকানগুলো। এই গ্রামের বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার বলেন, ‘জন্মের পর থেকে আমরা মা বনবিবির পূজা করছি।’ এ পূজা করলে সুন্দরবনের হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস।

কয়রা সদরের ১ নম্বর কয়রা গ্রামের মাতা বনবিবির মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, চলছে বনবিবির পূজার পুঁথির বয়ান। পুঁথির বয়ানে বনবিবির কাহিনি বর্ণনা করেন পুরোহিত। ভক্তরা গভীর মনোযোগে শোনেন সেই বয়ান। বনবিবির পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ভক্তরা ভিড় করেন মন্দিরে।

খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন চরামুখা গ্রামে বনবিবি পূজা ও মেলায় মাটির তৈরি পণ্যের সমাহার
ছবি: প্রথম আলো

বনবিবির পূজা প্রসঙ্গে কয়রা সদরের বনবিবি মন্দিরের পুরোহিত সন্তোষ কুমার রায় বলেন, পৌরাণিক রীতি অবলম্বনে এই এলাকায় ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে বনবিবির পূজা হয়; পাশাপাশি মেলাও হয়। বনে গিয়ে যাতে বনজীবীরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন, ভালো আয়রোজগার হয়, সেই ভাবনা থেকেই এ পূজা।

গতকাল রাতে সুন্দরবনসংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের পারের চরামুখা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কপোতাক্ষপারে খোলা মাঠে বসেছে মেলার আয়োজন। পাশে থাকা বনবিবি মন্দিরের সভাপতি ভোলানাথ মাঝি বলেন, এই মন্দির ঘিরেই এখানে বনবিবির পূজা ও মেলা হয়ে আসছে সেই ১২৮৩ বঙ্গাব্দ থেকে। এ হিসাবে এই মেলা ১৪২ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

মেলায় কেউ এসেছেন উপভোগ করতে, কেউবা বনবিবির কাছে কিছু চাইতে। বনবিবি মন্দিরের সামনে নারী-পুরুষের ভিড়ে দেখা হয়ে গেল কয়রা বড়বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হুমায়ুন কবিরের  সঙ্গে। মেলার ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এ এলাকার মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে দিনটির জন্য। এ অনুষ্ঠানের জন্য কাউকে দাওয়াত দিতে হয় না। ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে যুগ যুগ ধরে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে কয়রায়।