জামালপুরে ব্রহ্মপুত্রে ভাঙন
কৃষিজমি বিলীন, ঝুঁকিতে স্থাপনা
অসময়ের এই ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে শত বছরের পুরোনো একটি বাজার ও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আশপাশের গ্রামের বসতভিটা।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চরআমখাওয়া ইউনিয়নের পাটাধোয়াপাড়া থেকে মৌলভীরচর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। অসময়ের এই ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে শত বছরের পুরোনো একটি বাজার, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আশপাশের গ্রামের বসতভিটা। ইতিমধ্যে বহু কৃষিজমি বিলীন হয়েছে। অনেকে সরে গেছেন নিরাপদ স্থানে।
গত শনিবার বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সানন্দবাড়ি বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ বয়ে গেছে। ভাঙন এখন ওই বাজারের খুব কাছে চলে এসেছে। নদে পানি কম থাকলে প্রতিনিয়ত ভাঙন অব্যাহত থাকে। ওই বাজারের পশ্চিম পাশে পাটাধোয়াপাড়া থেকে মৌলভীরচর এলাকার মণ্ডলপাড়া, মুন্সিপাড়া, চুনালীপাড়া, চিথুলীয়া, পশ্চিম পাড়া, পশ্চিম পাটাধোয়াপাড়া, মৌলভীরচর, পাটাধোয়াপাড়া, খোলাবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে।
গত তিন বছরে মণ্ডলপাড়া, মুন্সিপাড়া, চুনালীপাড়া, চিথুলীয়া, পশ্চিম পাড়া, পশ্চিম পাটাধোয়াপাড়া ও খোলাবাড়ী এলাকার বেশির ভাগ অংশ নদের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙন অব্যাহত থাকলে শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী সানন্দবাড়ি বাজার, সানন্দবাড়ি ডিগ্রি কলেজ, সানন্দবাড়ি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, সানন্দবাড়ি পুলিশ তদন্তকেন্দ্র, মৌলভীরচর উচ্চবিদ্যালয়, মৌলভীরচর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, মৌলভীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মৌলভীরচর আলিম মাদ্রাসা, সানারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সানন্দবাড়ি পশ্চিম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খোলাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি গ্রাম বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
চরআমখাওয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল ইসলাম বলেন, গত তিন বছরে নদতীরবর্তী ৮টি গ্রামের প্রায় ৭০০ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের আতঙ্কে প্রায় ৮০০ পরিবার বসতভিটা ছেড়েছে। বিলীন হয়েছে অন্তত ২০০ একর কৃষিজমি। এখনো আটটি গ্রামের প্রায় তিন হাজার পরিবার রয়েছে ভাঙনের ঝুঁকিতে। এ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী সানন্দবাড়ি বাজার, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে নদের ভাঙন চলছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চরআমখাওয়া ইউনিয়নের পশ্চিম পাটাধোয়াপাড়া এলাকায় কৃষক আফছর আলী (৭৬)। তিনি ২০ বার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ গত বছর ভাঙনের শিকার হন। অন্যের জমিতে বসতঘর নির্মাণ করে থাকেন। এবার আবারও ভাঙন তাঁর বাড়ির খুব কাছে চলে আসছে। তিনি বলেন, ‘প্রায় এক যুগে ২০ বার ভাঙনের শিকার হয়েছি।
সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। কৃষিকাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাই। এই অঞ্চলের মানুষের জমিজমা ও সুখের সংসাসহ সবই ছিল। কিন্তু নদের ভাঙনের কারণে কেউ আর সুখে নাই। অনেকেই এই এলাকা থেকে ঢাকায় থাকেন। কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। এভাবে এই অঞ্চলের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে গেছেন। কিন্তু নদের ভাঙনে কখনো শক্ত কোনো বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।’
সানন্দবাড়ি পশ্চিম পাড়া এলাকার মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘বসতভিটাসহ প্রায় ৬৮ বিঘা কৃষিজমি নদের গর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন অন্যের জমিতে বসতঘর নির্মাণ করে আছি। সব হারিয়ে খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জীবন।’ পাটাধোয়াপাড়া গ্রামের রাবিয়া বেগম বলেন, ‘নদীর ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। ৭ বার বসতবাড়ি ভেঙে অন্য জায়গায় নিয়েছি। বহু আগেই জমিজমা নদের মধ্যে গেছে। এই এলাকায় নদের ভাঙন রোধে একটি বাঁধ হওয়ার দরকার। বাঁধ হলে বহু মানুষ ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।’
চরআমখাওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম বলেন, বর্ষাকালে নদের ভাঙন তীব্র হয়। কিন্তু এই অসময়ের নদের ভাঙনের কারণে নদতীরবর্তী মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক কাজ করছে। সানন্দবাড়ি বাজারটি ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে।
বাজারটি বিলীন হয়ে গেলে এই অঞ্চলের মানুষের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ, এই বাজারে কয়েক হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কয়েক হাজার মানুষের আয়ের একমাত্র পথ এই বাজার। দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজারটি রক্ষায় ভাঙন রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন।
জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, অসময়ে যে ভাঙন দেখা দিয়েছে, ওই ভাঙন প্রতিরোধের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটির অনুমোদন হলে ওই অঞ্চলের ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।